শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কোন কোন রচনায় পাওয়া যায়?
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি কোন কোন রচনায় পাওয়া যায়?
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। তাঁর রচনায় নারীর সামাজিক অবস্থান, মানসিক জটিলতা ও সংগ্রামকে গভীরভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে। তিনি নারীর অধিকার, স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন, যা তাঁর বিভিন্ন রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত রচনাসমূহ
১. চরিত্রহীন
কাহিনী: এই উপন্যাসে সাবিত্রী নামক এক নারীর জীবনের মাধ্যমে সমাজের কুসংস্কার, প্রথা ও নৈতিকতার দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়েছে।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: সাবিত্রী সমাজের বাধা উপেক্ষা করে নিজের জীবন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে চান। তাঁর সাহসী পদক্ষেপ ও স্বাবলম্বী মানসিকতা নারীর স্বাধীনতার প্রতীক।
২. দেনা-পাওনা
কাহিনী: কিরণময়ী ও মহিমের সম্পর্কের মাধ্যমে সমাজের আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরা হয়েছে।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: কিরণময়ীর চরিত্রের মাধ্যমে নারীর আত্মমর্যাদা ও নিজের অধিকারের প্রতি সচেতনতা প্রকাশ পেয়েছে।
৩. গৃহদাহ
কাহিনী: মহিম ও সুরেশের সাথে অচলার সম্পর্ক এবং তাঁর মানসিক দ্বন্দ্ব উপন্যাসের মূল বিষয়।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: অচলার নিজস্ব পরিচয় ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নারীর স্বাধীন সত্তার প্রতিফলন।
৪. শ্রীকান্ত
কাহিনী: শ্রীকান্তের ভ্রমণ ও বিভিন্ন মানুষের সাথে তাঁর সম্পর্কের মাধ্যমে জীবনের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: রাজলক্ষ্মী ও অভয়া চরিত্রের মাধ্যমে সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। তাঁরা স্বাবলম্বী ও স্বাধীনচেতা নারী।
৫. শেষ প্রশ্ন
কাহিনী: কমল ও অমিতের সম্পর্কের মাধ্যমে সমাজ, ধর্ম ও নৈতিকতার প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: কমল একটি স্বাধীনচেতা, শিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল নারী, যিনি সমাজের প্রচলিত নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন।
৬. পথের দাবী
কাহিনী: বিপ্লবী সুধা ও অপরেশের জীবনের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলন ও সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: সুধা একজন দৃঢ়চেতা নারী, যিনি জাতীয় আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেন।
৭. বিন্দুর ছেলে
কাহিনী: বিন্দুর সংগ্রাম ও মাতৃত্বের কাহিনী উপন্যাসের মূল বিষয়।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: বিন্দুর চরিত্রে মাতৃত্ব, ত্যাগ ও সমাজের সাথে সংগ্রামের চিত্রায়ণ হয়েছে।
৮. পরিণীতা
কাহিনী: ললিতা ও শেখরের প্রেমকাহিনী, যেখানে সমাজের শ্রেণীবৈষম্য ও কুসংস্কার বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: ললিতা একটি আত্মবিশ্বাসী ও শক্তিশালী চরিত্র, যিনি নিজের ভালবাসা ও অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেন।
উপসংহার
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর রচনায় নারীর মানসিকতা, সংগ্রাম ও সামাজিক অবস্থানকে গভীরভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি নারীদেরকে স্বাবলম্বী, স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে চিত্রায়িত করেছেন। সমাজের প্রচলিত কুসংস্কার ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী নারীবাদের পক্ষে শক্তিশালী বার্তা প্রদান করেছে। তাঁর রচনাগুলি আজও নারীর স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের পক্ষে প্রেরণা হিসেবে বিবেচিত হয়।