ভারতীয় রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা কী?
ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি ভারতের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নেতৃত্বে ভারতীয় রাজনীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। ইন্দিরা গান্ধী তার কঠোর নেতৃত্ব, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ভারতের রাজনীতিকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন। তিনি দু’বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে (১৯৬৬-১৯৭৭ এবং ১৯৮০-১৯৮৪) দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়কালে ভারতীয় রাজনীতিতে নানা পরিবর্তন ঘটে, যার প্রভাব আজও দৃশ্যমান।
নিচে ভারতীয় রাজনীতিতে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:
১. সবুজ বিপ্লব (Green Revolution):
ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ভারত কৃষিক্ষেত্রে একটি বড় রূপান্তর দেখে। তিনি সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেন। এটি ছিল ভারতের কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিপ্লব, যার ফলে ভারত খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে।
সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তি, উচ্চ ফলনশীল বীজ, এবং উন্নত সেচব্যবস্থা চালু করা হয়, যা ভারতের কৃষিক্ষেত্রের মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী করে তোলে। তার এই উদ্যোগের ফলে ভারত বহু বছর ধরে খাদ্য সংকট থেকে মুক্তি পেয়েছিল।
২. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা:
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে তিনি রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন প্রদান করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে নির্দেশ দেন। এর ফলে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
ইন্দিরা গান্ধীর এই সিদ্ধান্ত ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অবস্থানে নিয়ে আসে এবং ভারতের কৌশলগত গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়।
৩. বিপর্যয় অবস্থা (Emergency) ঘোষণা:
১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতের ইতিহাসে একটি বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যখন তিনি জরুরি অবস্থা (Emergency) ঘোষণা করেন। জরুরি অবস্থা ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন থেকে ১৯৭৭ সালের ২১ মার্চ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই সময়ে গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো সীমিত করা হয় এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেফতার করা হয়।
জরুরি অবস্থার সময় গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় এবং বিচারব্যবস্থা সহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। এই পদক্ষেপটি তাকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ফেলেছিল এবং এর ফলস্বরূপ ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে তার দল কংগ্রেস পরাজিত হয়।
৪. জাতীয়করণ নীতি:
ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ভারতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ খাতের জাতীয়করণ করা হয়। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের জাতীয়করণ একটি বড় পদক্ষেপ ছিল। ১৯৬৯ সালে তার সরকার ১৪টি প্রধান বাণিজ্যিক ব্যাংক জাতীয়করণ করে, যা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে এবং দরিদ্রদের জন্য ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ বৃদ্ধি করে।
এছাড়াও, কয়লা, তেল, এবং ইস্পাত শিল্পেও জাতীয়করণের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা ভারতের অর্থনীতিতে এক নতুন দিক উন্মোচন করে।
৫. শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি:
ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করেন এবং ভারতের অবস্থানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী করেন।
বিশেষ করে ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এছাড়া, ইন্দিরা গান্ধীর সময়ে ভারতের পরমাণু শক্তি উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং ১৯৭৪ সালে ‘অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধা’ এর মাধ্যমে ভারত তার প্রথম পরমাণু পরীক্ষা সম্পন্ন করে।
৬. গরিবি হটাও (Garibi Hatao) আন্দোলন:
ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতের দরিদ্রদের উন্নয়নের জন্য ‘গরিবি হটাও’ (দারিদ্র্য দূর করো) আন্দোলন শুরু হয়। তার নির্বাচনী প্রচারণার অন্যতম প্রধান স্লোগান ছিল “গরিবি হটাও”, যার মাধ্যমে তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন।
তার বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে, যদিও এর সফলতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
৭. পাঞ্জাবে অপারেশন ব্লু স্টার:
১৯৮৪ সালে পাঞ্জাবে অপারেশন ব্লু স্টার ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে ঘটে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিতর্কিত ঘটনা। এটি ছিল সন্ত্রাসবাদী শিখ আন্দোলনের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি সামরিক অভিযান, যেখানে পাঞ্জাবের অমৃতসরে অবস্থিত স্বর্ণমন্দিরে (গোল্ডেন টেম্পল) ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রবেশ করে এবং শিখ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।
এই অভিযানের ফলে ইন্দিরা গান্ধীকে শিখদের একাংশের তীব্র ক্ষোভের মুখে পড়তে হয় এবং এরই ফলস্বরূপ ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর তার দুই শিখ দেহরক্ষী তাকে হত্যা করে।
৮. নারীর ক্ষমতায়ন ও নেতৃত্বের প্রতীক:
ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রথম এবং একমাত্র মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ এবং বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি শুধু ভারতীয় নারীদের জন্য নয়, বরং সারা বিশ্বের নারীদের জন্য নেতৃত্ব এবং ক্ষমতায়নের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
তার শাসনামলে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, নারীরাও নেতৃত্ব দিতে পারে এবং দেশ পরিচালনার ক্ষমতা রাখে। তার নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক শক্তি ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
সারসংক্ষেপ:
ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার শাসনামলে ভারতের কৃষি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। তিনি কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পরিচিত ছিলেন, যদিও তার কিছু পদক্ষেপ বিতর্কিত ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে সাফল্য, এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে তিনি ভারতের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন।