ভারতের দিল্লি শহরের বায়ুদূষণ সমস্যার কারণ কী?
ভারতের দিল্লি শহরের বায়ুদূষণ সমস্যা বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম গুরুতর পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি। দিল্লির বায়ুদূষণ প্রতি বছর শীতকালে আরও মারাত্মক রূপ ধারণ করে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। দিল্লির বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলো বিভিন্ন উৎস এবং প্রভাব থেকে এসেছে, যা একসঙ্গে শহরের বায়ুর মানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
নিচে দিল্লি শহরের বায়ুদূষণের প্রধান কারণগুলো আলোচনা করা হলো:
১. যানবাহনের ধোঁয়া:
দিল্লি শহরে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক যানবাহন চলাচল করে, যার ফলে যানবাহন থেকে নির্গত ধোঁয়া বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। গাড়ি, মোটরসাইকেল, বাস, এবং ট্রাক থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂), কার্বন মনোক্সাইড (CO), নাইট্রোজেন অক্সাইড (NO₂), এবং সালফার ডাই অক্সাইড (SO₂) সরাসরি বায়ুদূষণ বাড়ায়।
দিল্লির মতো ব্যস্ত শহরে যানবাহনের সংখ্যা অত্যধিক, এবং বেশিরভাগ যানবাহন ডিজেল বা পেট্রোলচালিত, যা দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
২. শিল্প কারখানার নির্গমন:
দিল্লির আশেপাশে অবস্থিত শিল্প কারখানাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং রাসায়নিক বর্জ্য বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। বিশেষ করে, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং অন্যান্য ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, এবং অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাস নির্গত করে, যা বায়ুর গুণমানকে উল্লেখযোগ্যভাবে নষ্ট করে।
এছাড়া, এই অঞ্চলে অননুমোদিত ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানের বেআইনি কার্যক্রমও দূষণের মাত্রা বাড়ায়।
৩. কৃষি পোড়ানো (স্টাবল বার্নিং):
প্রতি বছর শীতের শুরুতে, বিশেষ করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, এবং উত্তর প্রদেশের কৃষকেরা ফসল কাটার পর জমির শুষ্ক অংশ (ফসলের অবশিষ্টাংশ বা স্টাবল) পুড়িয়ে দেয়। এই পোড়ানো থেকে প্রচুর পরিমাণে ধোঁয়া উৎপন্ন হয়, যা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে।
এই স্টাবল পোড়ানো থেকে নির্গত ধোঁয়া দিল্লির বায়ুর গুণমানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে, কারণ ধোঁয়া বাতাসে ভেসে শহরে পৌঁছে যায় এবং সেখানে তাপমাত্রার নিম্নগতি ও বাতাসের স্থবিরতার কারণে জমে থাকে।
৪. জ্বালানি পুড়ানো (বায়োমাস, কাঠ এবং কয়লা):
দিল্লির আশেপাশের অনেক এলাকায় এখনো বায়োমাস, কাঠ, এবং কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা থেকে প্রচুর ধোঁয়া ও বায়ুদূষণ ঘটে। এটি বিশেষ করে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এবং ছোটখাটো শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
দিল্লির বিভিন্ন নির্মাণ কার্যক্রম এবং খোলা জ্বালানির ব্যবহারও বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা পরোক্ষভাবে বায়ুদূষণের মাত্রা বাড়ায়।
5. নির্মাণ কাজ ও ধূলিকণা:
দিল্লিতে ব্যাপকভাবে নির্মাণ কাজ চলে, যা প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা উৎপন্ন করে। নির্মাণ কাজের ধূলিকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এবং বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নির্মাণ সামগ্রী যেমন বালু, সিমেন্ট, ইট ইত্যাদি খোলা আকাশে রাখার কারণে বাতাসে ধুলার পরিমাণ বেড়ে যায়।
এছাড়া, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজগুলোও প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা উত্পন্ন করে, যা বায়ুর গুণমানকে খারাপ করে।
৬. জনসংখ্যার চাপ এবং নগরায়ন:
দিল্লি শহরে অত্যধিক জনসংখ্যা এবং দ্রুত নগরায়নের কারণে পরিবেশের ওপর মারাত্মক চাপ পড়ছে। শহরের ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন, এবং নির্মাণ কার্যক্রম বেড়েছে, যা বায়ুদূষণকে বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে।
৭. শীতকালে বায়ুর গতির ধীরগতি:
শীতকালে দিল্লির বায়ুদূষণ আরও গুরুতর আকার ধারণ করে। শীতের সময়ে বায়ুর গতি ধীর হয়ে যায়, এবং বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে ধোঁয়া ও অন্যান্য দূষক কণাগুলো আটকে থাকে। এই সময়ে বায়ুপ্রবাহের অভাবে ধোঁয়া জমে থাকে এবং শহরের বাতাসে দূষণ জমে যাওয়ার ফলে বায়ুর গুণমান আরও খারাপ হয়ে যায়।
৮. ফায়ারক্র্যাকার ও উৎসবের দূষণ:
দিল্লিতে দীপাবলির মতো উৎসবের সময় প্রচুর পরিমাণে ফায়ারক্র্যাকার (আতশবাজি) ফাটানো হয়, যা বাতাসে প্রচুর পরিমাণে বিষাক্ত কণা ছড়ায়। আতশবাজির ধোঁয়া এবং তার রাসায়নিক পদার্থগুলো বাতাসে মিশে বায়ুর গুণমানকে মারাত্মকভাবে নষ্ট করে। দীপাবলির সময় বায়ুদূষণ মাত্রা সবসময় অত্যন্ত বেশি থাকে।
সারসংক্ষেপ:
দিল্লির বায়ুদূষণের কারণগুলো বহুবিধ এবং তা যানবাহন, শিল্পকারখানা, স্টাবল পোড়ানো, নির্মাণ কার্যক্রম, এবং উৎসবের দূষণ থেকে উদ্ভূত হয়। এসব কারণগুলো বিশেষ করে শীতকালে বায়ুদূষণের মাত্রা গুরুতর করে তোলে, কারণ বায়ুর গতি ধীর হয়ে যায় এবং দূষক কণাগুলো বাতাসে আটকে থাকে। এর ফলে দিল্লির পরিবেশ এবং মানুষের স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।