বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও ভারতের প্রভাব কী?

0

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও ভারতের প্রভাব কী?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
0

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও ভারতের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমুখী। ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করে। চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বাংলাদেশ তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় এনে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং কৌশলগত স্বার্থে এই দুই দেশের ভূমিকা অপরিসীম।

নিচে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও ভারতের প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. ভারতের প্রভাব:
ক. ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক:

ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ এবং বাংলাদেশকে তিন দিক থেকে ঘিরে রেখেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল এবং সে সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এই সম্পর্ক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের বিশেষ প্রভাব তৈরি করেছে।

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ভারতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। তাই দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।
খ. অর্থনৈতিক সম্পর্ক:

ভারত বাংলাদেশের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে, ভারত থেকে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণে পণ্য আমদানি হয়। তবে, বাণিজ্য ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ প্রায়ই সমতা আনতে চেষ্টা করে।

ভারত বাংলাদেশে সরাসরি বিনিয়োগ করে এবং বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন করে থাকে। উভয় দেশ সীমান্ত বাণিজ্য এবং পরিবহনে সহযোগিতা করে আসছে।
গ. জলবণ্টন ও সীমান্ত সমস্যা:

গঙ্গা, তিস্তা, এবং অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের সমস্যা রয়েছে। বিশেষ করে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এখনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি, যা বাংলাদেশের কৃষি এবং অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে।

সীমান্ত সমস্যা এবং সীমান্তে গুলি চালানোর ঘটনা সম্পর্কেও দুই দেশের মধ্যে আলোচনা ও সমঝোতা প্রয়োজন। এ ধরনের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে দুই দেশ সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছে।
ঘ. নিরাপত্তা ও কৌশলগত সম্পর্ক:

বাংলাদেশ এবং ভারত আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করে থাকে। বিশেষ করে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, সীমান্ত সুরক্ষা, এবং মাদক পাচার বন্ধে উভয় দেশ নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদার করেছে। ভারত বাংলাদেশে রেললাইন, সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পেও বিনিয়োগ করছে, যা উভয় দেশের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ককে মজবুত করেছে।

২. চীনের প্রভাব:
ক. অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ:

চীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বড় বিনিয়োগকারী। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প, যেমন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল প্রকল্প, এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীন সহযোগিতা করছে। চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

চীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় রপ্তানি বাজারও বটে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের একটি বড় রপ্তানিকারক দেশ।
খ. কৌশলগত সম্পর্ক:

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে। চীন বাংলাদেশকে তার আঞ্চলিক কৌশলগত প্রভাবের অংশ হিসেবে দেখে এবং এতে বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের একটি অংশ, যা আঞ্চলিক যোগাযোগ ও অবকাঠামো উন্নয়নের দিকে জোর দেয়।

কৌশলগত দিক থেকে, চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক বাড়াতে চায় এবং বাংলাদেশকে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গণ্য করে।
গ. প্রতিরক্ষা সহযোগিতা:

চীন বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহকারী দেশ। বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম, যুদ্ধবিমান, এবং অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম কিনে থাকে। দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্ক দিন দিন আরও মজবুত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক।

ঘ. আন্তর্জাতিক মঞ্চে সহযোগিতা:

চীন ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মঞ্চে একে অপরকে বিভিন্ন বিষয়ে সমর্থন করে। জাতিসংঘের বিভিন্ন ইস্যুতে চীন বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন দিয়ে থাকে, এবং চীন বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে সহায়তা করে আসছে।

৩. ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি:
বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চেষ্টা করে। চীন ও ভারতের মধ্যে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ উভয় দেশের সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্ক রক্ষা করার চেষ্টা করছে। অর্থনৈতিক, কৌশলগত এবং রাজনৈতিকভাবে উভয় দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশ তার স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করে।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীনের সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভারতীয় কৌশলগত এবং নিরাপত্তা সম্পর্ককেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সহায়ক।
সারসংক্ষেপ:
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে চীন ও ভারতের প্রভাব গভীর এবং বহুমুখী। ভারতের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক সম্পর্ক, বাণিজ্য, এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে, চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক দিন দিন বাড়ছে এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে চীনের বিনিয়োগের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মূলত ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেখানে দেশটি উভয় বৃহৎ প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজস্ব উন্নয়ন ও স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
আপনি 1 উত্তরের মধ্যে 1টি দেখছেন, সব উত্তর দেখতে এখানে ক্লিক করুন।

বিভাগসমূহ