ভারতের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ভূমিকা কী?

83 বার দেখারাজনীতিউন্নয়ন পরিকল্পনা ভারত
0

ভারতের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ভূমিকা কী?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
0

ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (Five-Year Plans) দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৫১ সালে স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় এবং সেই থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট বারোটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চালু ছিল। ভারতের কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বে এই পরিকল্পনাগুলো তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা হতো। এই পরিকল্পনাগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার, দারিদ্র্য হ্রাস, এবং দেশের শিল্প, কৃষি ও অবকাঠামোর উন্নতি।

নিচে ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন দিকগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

১. কৃষি খাতের উন্নয়ন:
প্রথম কয়েকটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়ে ভারতের কৃষি খাতের ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল, কারণ স্বাধীনতার পর কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ছিল অত্যন্ত কম। সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা ছিল একটি প্রধান লক্ষ্য।

উদাহরণস্বরূপ, তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সবুজ বিপ্লবের সূচনা হয়, যার মাধ্যমে উন্নত মানের বীজ, সেচ, সার এবং কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়। এর ফলে ভারত খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে এবং খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়।
২. শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন:
ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য ছিল শিল্পায়ন। বিশেষ করে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়ে ভারী শিল্প, লৌহ-ইস্পাত শিল্প, এবং মেশিন তৈরির কারখানা গড়ে তোলার জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করা হয়। শিল্প খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি এবং অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী করা ছিল এর প্রধান লক্ষ্য।

এ পরিকল্পনাগুলোর মাধ্যমে ভারতে বেশ কয়েকটি বড় শিল্প কারখানা এবং অবকাঠামো প্রকল্পের সূচনা হয়, যেমন ভিলাই, রৌরকেল্লা এবং দুর্গাপুরের ইস্পাত কারখানা, যা ভারতের শিল্প খাতকে মজবুত ভিত্তি দেয়।
৩. দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক ন্যায়বিচার:
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষ করে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময় দারিদ্র্য বিমোচনের দিকে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। এতে বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সাহায্য করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে দরিদ্রদের জন্য মজুরি কর্মসূচি, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যা দেশের সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
৪. মানবসম্পদ উন্নয়ন:
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটানো হয়। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দেওয়া হয়, যাতে দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী দক্ষ হয়ে ওঠে এবং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব হয়।

মিড-ডে মিল এবং সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্পের মতো কর্মসূচিগুলো প্রাথমিক শিক্ষার হার বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, যা জনসংখ্যার মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক হয়েছে।
৫. গ্রামীণ উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান:
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতের গ্রামীণ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সেচ ব্যবস্থা, গ্রামীণ সড়ক যোগাযোগ, এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়।

মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি অ্যাক্ট (MGNREGA) প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে দরিদ্র জনগণের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়, যা দারিদ্র্য বিমোচন এবং গ্রামীণ উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।
৬. শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে উন্নতি:
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ভারতে বিভিন্ন প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন করা হয়, বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি), টেলিযোগাযোগ, এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা খাতে। ভারত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

উদাহরণস্বরূপ, আইটি শিল্প এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ ও উন্নয়ন কর্মসূচি ভারতের অর্থনীতির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে, যা দেশের আর্থিক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
৭. নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক উন্নয়ন:
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামাজিক উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যা ভারতের সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

৮. দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও পরিবেশ রক্ষা:
পরবর্তী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোতে পরিবেশ রক্ষা, পরিবেশ বান্ধব উন্নয়ন এবং টেকসই উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ভারতের উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবেশগত সচেতনতা বাড়ানো হয় এবং জ্বালানি সংরক্ষণ, বন সংরক্ষণ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়।

৯. অবকাঠামো উন্নয়ন:
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সড়ক, রেলপথ, বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে দেশব্যাপী অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বাণিজ্য, পরিবহন, এবং শিল্প খাতের প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছে।

গোল্ডেন কোয়াড্রিলেটাল প্রকল্প, বন্দে ভারত রেল প্রকল্প এবং অন্যান্য বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অধীনে শুরু হয়, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় অবদান রেখেছে।
সারসংক্ষেপ:
ভারতের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই পরিকল্পনাগুলোর মাধ্যমে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, এবং অবকাঠামো খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, এবং গ্রামীণ উন্নয়নে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন কর্মসূচি হিসেবে কাজ করেছে।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
আপনি 1 উত্তরের মধ্যে 1টি দেখছেন, সব উত্তর দেখতে এখানে ক্লিক করুন।

বিভাগসমূহ