বাংলা সাহিত্যে ‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলন কী?
বাংলা সাহিত্যে ‘হাংরি জেনারেশন’ বা ‘হাংরি আন্দোলন’ ছিল ১৯৬০-এর দশকের একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা মূলত আধুনিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী এবং পরীক্ষামূলক সাহিত্য সৃষ্টি করার লক্ষ্যে গড়ে উঠেছিল। এই আন্দোলনের লেখকরা প্রচলিত সমাজ, সাহিত্য, এবং সংস্কৃতির সঙ্গে চরম বিরোধিতা করে তাদের চিন্তা ও সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্যের নতুন ধারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এই আন্দোলন ছিল মূলত কবিতা ও ছোটগল্পকেন্দ্রিক, এবং এর মাধ্যমে প্রচলিত সাহিত্যিক শৃঙ্খলাকে ভেঙে নতুন এক সাহিত্যের জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।
হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের পটভূমি:
১৯৫০-এর দশকের শেষ এবং ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ভারতে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে তরুণ সমাজের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম নেয়। স্বাধীনতার পরে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং সামাজিক অসামঞ্জস্য এই ক্ষোভকে তীব্র করে তোলে। এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে প্রচলিত শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং প্রথাগত ধারা থেকে বেরিয়ে আসার একটি প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়।
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান লেখক:
হাংরি আন্দোলনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মলয় রায় চৌধুরী, এবং তার সঙ্গে ছিলেন বেশ কয়েকজন তরুণ কবি ও লেখক, যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ ঘোষ, বসন্ত কুমার ঘোষ, দেবী রায়, সলিল চৌধুরী, এবং আরও অনেকে। তারা সবাই প্রচলিত সাহিত্যিক ধারা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং সাহিত্যের এক নতুন দিক উন্মোচনের চেষ্টা করেন।
আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ও ভাবনা:
‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত সাহিত্যিক ধারা এবং প্রথাকে চ্যালেঞ্জ করা। তারা বিশ্বাস করতেন যে, সাহিত্যকে শুধু সমাজের অভিজাত শ্রেণির জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবন, সংগ্রাম, এবং বঞ্চনার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। তাদের রচনায় সমাজের প্রতি গভীর অসন্তোষ, দারিদ্র্য, শোষণ, এবং হতাশার কথা উঠে আসে।
“হাংরি” শব্দটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, যা ক্ষুধার্ত মানুষের অন্তর্গত ক্ষুধা এবং সমাজে বিরাজমান বঞ্চনার প্রতীক। এটি শুধু শারীরিক ক্ষুধা নয়, বরং সাংস্কৃতিক, সামাজিক, এবং মানসিক ক্ষুধাকেও ইঙ্গিত করে।
তারা প্রচলিত শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, এবং ভাষার ব্যবহার নিয়ে তীব্র বিদ্রোহী মনোভাব পোষণ করতেন। তাদের রচনায় ছিল খোলামেলা, সরাসরি এবং কখনও কখনও অশ্লীল শব্দের ব্যবহার, যা তখনকার সাহিত্যিক সমাজে প্রচণ্ড বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল।
আন্দোলনের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য:
১. ভাষার ভাঙচুর: হাংরি আন্দোলনের কবিতায় ভাষার প্রচলিত রীতি ভেঙে এক নতুন ধরনের সাহিত্য রচনা করা হয়। প্রচলিত শব্দের ব্যবহার এবং বাক্যগঠনকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
২. প্রতিবাদমূলক বিষয়বস্তু: হাংরি আন্দোলনের লেখাগুলোতে সমাজের প্রতি তীব্র ক্ষোভ ও বিদ্রোহ প্রকাশিত হয়। সমাজের শোষণ, দারিদ্র্য, এবং মানুষের দুর্দশা তাদের লেখার মূল বিষয় ছিল।
৩. অশ্লীলতা ও যৌনতার খোলামেলা চিত্রায়ণ: তারা সমাজের ভণ্ডামি এবং রক্ষণশীল মানসিকতার বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ করেন। যৌনতা এবং মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাদের রচনায় খোলামেলা ও সাহসিকতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছিল।
৪. প্রথা ভাঙার সাহসিকতা: তারা সাহিত্যের প্রচলিত শৃঙ্খলা ও প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্রোহ করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল নতুন চিন্তাধারা এবং সৃজনশীলতাকে সাহিত্যের মধ্যে প্রবেশ করানো।
আন্দোলনের প্রভাব:
‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে এবং ভারতের সাহিত্যে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর সাহসী এবং বিদ্রোহী ভাবনা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে, এই আন্দোলনকে মূলধারার সাহিত্যিক ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। আন্দোলনের বেশ কয়েকজন কবি ও লেখকের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং তাদের রচনা নিষিদ্ধ করা হয়।
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব:
যদিও ‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলন খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি, তবে এটি বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। এই আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের ভাষা, ভাব, এবং প্রকাশভঙ্গিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে এবং পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখক এই আন্দোলনের প্রভাবিত হন।
সারসংক্ষেপ:
বাংলা সাহিত্যে ‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলন ছিল একটি সাহসী এবং প্রথাবিরোধী আন্দোলন, যা সমাজের প্রতি তীব্র ক্ষোভ, শোষণের প্রতিবাদ, এবং সৃজনশীলতার নতুন দিক উন্মোচনের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন যুগের সূচনা করেছিল।