কেন আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হয়?
আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হয় মূলত ভূগর্ভস্থ ম্যাগমার (Magma) চাপ এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরে থাকা গরম ম্যাগমা, গ্যাস, এবং অন্যান্য ভূতাত্ত্বিক উপাদান যখন ভূপৃষ্ঠের দিকে উঠে আসে এবং বিস্ফোরিত হয়, তখন আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
নিচে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের কারণ এবং প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
১. ম্যাগমার চাপ বৃদ্ধি (Pressure Build-up in Magma Chamber):
ম্যাগমা চেম্বার: পৃথিবীর ভূত্বকের নিচে একটি চেম্বারের মতো জায়গা থাকে, যেখানে ম্যাগমা (গলিত শিলা, গ্যাস, এবং অন্যান্য উপাদান) জমা হয়। এটিকে ম্যাগমা চেম্বার বলা হয়।
চাপ বৃদ্ধি: ভূত্বকের গভীরে থাকা তাপমাত্রা এবং ভূতাত্ত্বিক চাপের কারণে ম্যাগমা উত্তপ্ত ও আকারে প্রসারিত হতে থাকে। এর ফলে ম্যাগমা চেম্বারের মধ্যে চাপ বাড়তে থাকে।
চাপ সহ্য করতে না পারা: একসময় এই চাপ এত বেশি হয়ে যায় যে, ভূত্বক আর তা সহ্য করতে পারে না এবং ম্যাগমা উপরে উঠতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণে রূপ নেয়।
২. গ্যাসের সঞ্চয় এবং বিস্ফোরণ (Gas Accumulation and Explosion):
গ্যাসের উপস্থিতি: ম্যাগমার ভেতরে প্রচুর গ্যাস থাকে, যেমন জলীয় বাষ্প (Water vapor), কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2), সালফার ডাই অক্সাইড (SO2) ইত্যাদি।
গ্যাসের চাপ বৃদ্ধি: ম্যাগমার সাথে থাকা এই গ্যাসগুলি চাপ বাড়িয়ে তোলে এবং একসময় এই গ্যাসগুলি হঠাৎ করে ছাড়তে শুরু করে, যা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটায়।
গ্যাস নির্গমনের প্রক্রিয়া: ভূত্বকের দুর্বল অংশ বা ফাটলের মধ্য দিয়ে এই গ্যাসগুলি দ্রুত বেরিয়ে আসে এবং বিস্ফোরণের সাথে প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে ম্যাগমাকে ভূপৃষ্ঠের দিকে ঠেলে দেয়।
৩. প্লেট টেকটনিকের কার্যকলাপ (Tectonic Plate Activity):
প্লেট টেকটনিক: পৃথিবীর ভূত্বক বিভিন্ন টেকটোনিক প্লেটে বিভক্ত। এই প্লেটগুলো একে অপরের সাথে সংঘর্ষ বা দূরত্ব তৈরি করলে ভূত্বকের ভেতরে চাপের সৃষ্টি হয়।
প্লেটের সংঘর্ষ: দুটি টেকটোনিক প্লেট যখন একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করে, তখন একটি প্লেট অন্যটির নিচে ঢুকে পড়ে, যার ফলে ম্যাগমার জন্য ভূত্বকের একটি ফাটল তৈরি হয়। এই ফাটল দিয়ে ম্যাগমা এবং গ্যাস বের হয়ে আসে এবং আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে।
প্লেটের বিভাজন: প্লেটের দূরত্ব বাড়লে ভূত্বকে ফাটল সৃষ্টি হয়, যার মধ্য দিয়ে ম্যাগমা উঠে আসে।
৪. ম্যাগমার ঘনত্ব এবং তাপমাত্রা (Density and Temperature of Magma):
ঘন এবং তপ্ত ম্যাগমা: যখন ভূত্বকের নিচে থাকা ম্যাগমা ঘন এবং তাপমাত্রা খুব বেশি হয়, তখন এটি সহজে উপরে উঠতে চায় এবং প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে।
কম ঘনত্বের ম্যাগমা: কম ঘনত্বের ম্যাগমা সহজে উপরে উঠে আসে এবং বিস্ফোরণ ঘটায়, কারণ এটি তুলনামূলকভাবে হালকা এবং দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসে।
৫. ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ (Earthquakes and Volcanic Eruptions):
ভূমিকম্পের প্রভাব: ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকে কম্পন সৃষ্টি হয় এবং এতে ভূত্বকের বিভিন্ন অংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বল অংশ দিয়ে ম্যাগমা এবং গ্যাস বের হতে শুরু করে, যা আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
কম্পন এবং ফাটল: ভূমিকম্পের সময় সৃষ্টি হওয়া ফাটলগুলো ম্যাগমা এবং গ্যাসের নির্গমনের জন্য পথ তৈরি করে, যা বিস্ফোরণের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
৬. জলীয় পদার্থের ভূমিকা (Role of Water):
জলের চাপ: ভূত্বকের নিচে থাকা জলীয় বাষ্প ম্যাগমার সাথে মিশে এর তাপমাত্রা এবং চাপ বৃদ্ধি করে। এই অতিরিক্ত চাপ ম্যাগমাকে দ্রুত উপরে উঠতে সহায়তা করে।
জলের উত্তপ্ত বিস্ফোরণ: জলীয় পদার্থ ম্যাগমার মধ্যে প্রবেশ করলে তা দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে বাষ্পে পরিণত হয় এবং এক বিশাল বিস্ফোরণ ঘটায়।
আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের প্রকারভেদ (Types of Volcanic Eruptions):
এক্সপ্লোসিভ ইরাপশন (Explosive Eruption):
প্রচণ্ড শক্তিশালী বিস্ফোরণ, যার মাধ্যমে ম্যাগমা, ছাই, এবং গ্যাস দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসে।
সাধারণত বেশি ঘনত্বের ম্যাগমা এবং প্রচুর গ্যাসযুক্ত আগ্নেয়গিরিতে এ ধরনের বিস্ফোরণ ঘটে।
এফিউজিভ ইরাপশন (Effusive Eruption):
এই ধরনের বিস্ফোরণে ম্যাগমা শান্তভাবে উপরে উঠে আসে এবং লাভা প্রবাহিত হয়।
সাধারণত কম ঘনত্বের ম্যাগমা থাকার ফলে এই প্রকারের বিস্ফোরণ ঘটে, যেখানে কম গ্যাস থাকে।
উপসংহার:
আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে মূলত ভূগর্ভস্থ ম্যাগমার চাপ, তাপমাত্রা, এবং গ্যাসের কারণে। ভূত্বকের ফাটল, টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষ, এবং ভূমিকম্পের মতো বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনা এই বিস্ফোরণের কারণ হতে পারে। যখন ভূগর্ভস্থ চাপ নির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন ম্যাগমা ও গ্যাস দ্রুত ভূত্বক ভেদ করে বেরিয়ে আসে এবং আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে।