ব্রিটিশ শাসনের শুরু বাংলায় কীভাবে হয়েছিল?

82 বার দেখাইতিহাসবাংলা
0

ব্রিটিশ শাসনের শুরু বাংলায় কীভাবে হয়েছিল?

মুহাম্মদ ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024
0

বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা ১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ঘটে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে তারা ধীরে ধীরে বাংলার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাথমিক আগমন
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠা

১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠা: ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সালে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলায় আগমন: ১৭শ শতাব্দীতে কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্যিক কারখানা বা বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে, যেমন হুগলী, কাসিমবাজার ও কলকাতা।
মুঘল সম্রাটের অনুমতি: মুঘল সম্রাটদের কাছ থেকে বিভিন্ন সনদ ও ফারমান নিয়ে তারা বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করত।
বাণিজ্যিক সুবিধা ও শুল্কমুক্ত বাণিজ্য

১৬৯৮ সালে জমি ক্রয়: কোম্পানি সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা গ্রামের জমিদারি অধিকার ক্রয় করে।
শুল্কমুক্ত বাণিজ্য: মুঘল সম্রাট ফারুক সিয়ারের কাছ থেকে ১৭১৭ সালে ‘দস্তক’ নামক সনদ পায়, যা শুল্কমুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা দেয়।
ব্রিটিশ ও নবাবদের মধ্যে সংঘর্ষ
শাসন ও বাণিজ্য নিয়ে বিরোধ

শুল্কমুক্ত বাণিজ্য নিয়ে অসন্তোষ: ব্রিটিশদের শুল্কমুক্ত বাণিজ্য বাংলার নবাবদের রাজস্ব আয়ে প্রভাব ফেলে।
কর্মচারীদের দুর্নীতি: কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত লাভের জন্য শুল্কমুক্তির অপব্যবহার করতে থাকে।
নবাবদের আপত্তি: নবাব আলিবর্দী খান ও পরবর্তীতে সিরাজউদ্দৌলা এই বিষয়ে আপত্তি তোলেন।
কলকাতা দুর্গ নির্মাণ নিয়ে বিরোধ

দুর্গ মজবুতকরণ: ব্রিটিশরা নবাবের অনুমতি ছাড়াই কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ মজবুত করতে থাকে।
নবাবের আপত্তি: সিরাজউদ্দৌলা এটিকে তাঁর শাসনের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখেন এবং দুর্গ নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দেন।
পলাশীর যুদ্ধ (১৭৫৭)
যুদ্ধের কারণ

নবাবের আক্রমণ: নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা আক্রমণ করে এবং ব্রিটিশদের পরাজিত করেন।
ব্রিটিশদের প্রতিশোধ: ব্রিটিশরা মাদ্রাজ থেকে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে সৈন্য এনে কলকাতা পুনরুদ্ধার করে।
চক্রান্ত: ব্রিটিশরা নবাবের সৈন্যবাহিনীর প্রধান মীর জাফর ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সাথে ষড়যন্ত্র করে।
যুদ্ধ ও ফলাফল

যুদ্ধের তারিখ: ২৩ জুন ১৭৫৭।
ব্রিটিশ বিজয়: মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে নবাবের পরাজয় ঘটে এবং সিরাজউদ্দৌলা নিহত হন।
মীর জাফরের নবাব হওয়া: ব্রিটিশদের পুতুল শাসক হিসেবে মীর জাফরকে নবাব করা হয়।
বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪)
যুদ্ধের কারণ

মীর কাসিমের বিরোধ: মীর জাফরের পরে মীর কাসিম নবাব হন, কিন্তু ব্রিটিশদের সাথে তাঁর বিরোধ দেখা দেয়।
ত্রিপক্ষীয় জোট: মীর কাসিম, আওধের নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মুঘল সম্রাট শাহ আলম II ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধেন।
যুদ্ধ ও ফলাফল

যুদ্ধের তারিখ: ২২ অক্টোবর ১৭৬৪।
ব্রিটিশ বিজয়: বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়ী হয়।
দিওয়ানি অধিকার প্রাপ্তি: ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাট ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানি বা রাজস্ব আদায়ের অধিকার প্রদান করেন।
ব্রিটিশ শাসনের সূচনা
দ্বৈত শাসন পদ্ধতি

দ্বৈত শাসন: প্রশাসনিক দায়িত্ব নবাবের হাতে থাকলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশদের হাতে।
রাজস্ব আদায়: ব্রিটিশরা রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে বাংলার অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে।
অর্থনৈতিক শোষণ ও সমাজিক প্রভাব

বাণিজ্যিক স্বার্থ: ব্রিটিশরা বাংলার সম্পদ ও অর্থ ইউরোপে স্থানান্তর করতে থাকে।
কুটির শিল্পের ধ্বংস: ব্রিটিশ নীতির ফলে বাংলার কুটির শিল্প ও বস্ত্রশিল্প বিপর্যস্ত হয়।
দুর্ভিক্ষ ও দুর্দশা: অর্থনৈতিক শোষণের ফলে ১৭৭০ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটে, যেখানে লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
প্রশাসনিক ও আইনগত পরিবর্তন
সুডেন ওয়েলেসলির সংস্কার: ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট ও পরবর্তী আইনগুলির মাধ্যমে প্রশাসনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়।
বিচার বিভাগ স্থাপন: দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচার ব্যবস্থা ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে আসে।
উপসংহার
বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা হয় বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা ও সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। পলাশীর যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধ ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করে। দেওয়ানি অধিকার প্রাপ্তির মাধ্যমে তারা বাংলার অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে, যা পরবর্তীতে সমগ্র ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে। বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে এই শাসন গভীর প্রভাব ফেলে, যা ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

মুহাম্মদ ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024

বিভাগসমূহ