পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান কী?

24 বার দেখাইতিহাসপশ্চিমবঙ্গ
0

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান কী?

মুহাম্মদ ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024
0

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির (মূলত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি [সিপিআই] এবং পরবর্তীতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি [মার্কসবাদী] বা সিপিআইএম) অবদান গভীর ও ব্যাপক। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা ৩৪ বছর বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্বে থেকে তারা রাজ্য পরিচালনা করেছে, যা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কমিউনিস্ট শাসনের একটি উদাহরণ।

ইতিহাস ও প্রতিষ্ঠা
প্রাথমিক বছর ও স্বাধীনতা পূর্বকাল

কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা (১৯২০-এর দশক): ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্টরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬): কৃষকদের অধিকার ও জমির মালিকানার দাবিতে এই আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্ব দেয়, যা কৃষক আন্দোলনে একটি মাইলফলক।
স্বাধীনতা পরবর্তী যুগ
১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশক

রাজনৈতিক উত্থান: স্বাধীনতার পর কমিউনিস্ট পার্টি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকে।
১৯৬৪ সালে বিভক্তি: সিপিআই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সিপিআইএম গঠিত হয়, যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রধান কমিউনিস্ট শক্তি হয়ে ওঠে।
যুক্তফ্রন্ট সরকার (১৯৬৭ ও ১৯৬৯)

প্রথম বামপন্থী সরকার: ১৯৬৭ সালে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়, যেখানে সিপিআইএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কৃষি ও শ্রম নীতি: কৃষকদের অধিকার ও শ্রমিকদের কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
বামফ্রন্টের শাসনকাল (১৯৭৭-২০১১)
ক্ষমতায় আগমন

১৯৭৭ সালের নির্বাচন: বামফ্রন্ট সরকার প্রথমবারের মতো বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে।
জ্যোতি বসুর নেতৃত্ব: জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২৩ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
ভূমি সংস্কার ও অপারেশন বর্গা

ভূমি সংস্কার: জমি মালিকানায় পরিবর্তন এনে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে জমি বণ্টন করা হয়।
অপারেশন বর্গা: বর্গাদারদের অধিকার সুরক্ষিত করতে এই প্রোগ্রাম চালু করা হয়, যা কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায়।
পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থা

বিকেন্দ্রীকরণ: গ্রামীণ প্রশাসনে পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়, যা গ্রাম পর্যায়ে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে।
গ্রামীণ উন্নয়ন: স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা

শিক্ষা প্রসার: সরকারি বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়।
সাক্ষরতা অভিযান: সাধারণ মানুষের মধ্যে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পায়, যা সামাজিক উন্নয়নে সহায়ক হয়।
শ্রমিক ও শ্রমনীতি

শ্রমিক অধিকার: শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মস্থলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন: শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাঁদের অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধর্মনিরপেক্ষতা

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি: ধর্মনিরপেক্ষ নীতির মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা হয়।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন: তফসিলি জাতি ও উপজাতির কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রভাব
সাংস্কৃতিক আন্দোলন: নাটক, সাহিত্য ও শিল্পকলায় বামপন্থী চিন্তাধারার প্রভাব পড়ে।
শিক্ষা ও বুদ্ধিজীবী মহল: শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবী মহলে বামপন্থী নীতির সমর্থন বৃদ্ধি পায়।
চ্যালেঞ্জ ও পতন
নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর সমস্যা

শিল্পায়ন নীতি: সরকার শিল্পায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর আন্দোলন: জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষদের আন্দোলন শুরু হয়, যা সরকারের প্রতি জনসমর্থন কমিয়ে দেয়।
২০১১ সালের নির্বাচন ও পরিবর্তন

পরাজয়: ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে বামফ্রন্ট পরাজিত হয়।
জনসমর্থন হ্রাস: দীর্ঘ শাসনকালে প্রশাসনিক জটিলতা, দুর্নীতি ও জনগণের অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়।
উপসংহার
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান বহুমুখী ও গভীর। ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত রাজ ব্যবস্থা, শিক্ষা ও শ্রমিক কল্যাণে তাদের পদক্ষেপগুলি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। যদিও শেষের দিকে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে তারা ক্ষমতা হারিয়েছে, তবুও তাদের দীর্ঘ শাসনকাল পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। কমিউনিস্ট পার্টির নীতিমালা ও কার্যক্রম রাজ্যের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

মুহাম্মদ ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024

বিভাগসমূহ