মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ কীভাবে মহাকাব্যিক রীতি অনুসরণ করেছে?

0

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ কীভাবে মহাকাব্যিক রীতি অনুসরণ করেছে?

মুহাম্মদ ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024
0

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ (১৮৬১) বাংলা সাহিত্যের একটি প্রখ্যাত মহাকাব্য, যা রামায়ণের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে রচিত। তবে, প্রচলিত ধারার বিপরীতে মধুসূদন এতে রাবণের পুত্র মেঘনাদকে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কাব্যটি মহাকাব্যিক রীতি অনুসরণ করে রচিত, যা বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

মহাকাব্যিক রীতি অনুসরণের উপায়সমূহ:
১. বিষয়বস্তু ও কাহিনীর গাম্ভীর্য:

বীরত্ব ও বীরত্বের মহিমা: মহাকাব্যের মূল বৈশিষ্ট্য হলো বীরত্বপূর্ণ কাহিনী। মেঘনাদ বধ কাব্যে মেঘনাদের বীরত্ব, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকে কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক প্রেক্ষাপট: কাব্যটি রামায়ণের লঙ্কাকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে রচিত, যা মহাকাব্যের জন্য উপযুক্ত।
২. মহাকাব্যের গঠন ও প্রকার:

সর্গ বিভাজন: কাব্যটি ৯টি সর্গে বিভক্ত, যা মহাকাব্যের প্রচলিত গঠনরীতির অনুসরণ।
দীর্ঘ আকার: কাহিনীর বিস্তৃত বর্ণনা ও বিশদ চিত্রণ মহাকাব্যের আকারকে পূর্ণ করেছে।
৩. অলঙ্কার ও ভাষাশৈলী:

অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার: মধুসূদন প্রথম বাংলা সাহিত্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন, যা মহাকাব্যের গাম্ভীর্য ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।
সমৃদ্ধ অলঙ্কার: উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, অনুপ্রাস প্রভৃতি অলঙ্কারের মাধ্যমে ভাষাকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে।
উচ্চাঙ্গের ভাষা: সংস্কৃতঘেঁষা শব্দ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষার ব্যবহার মহাকাব্যের রীতি অনুসরণ করে।
৪. দেবতা ও অতিপ্রাকৃত শক্তির ভূমিকা:

ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ: কাব্যে দেবতা ও দেবীদের উপস্থিতি ও তাঁদের হস্তক্ষেপ মহাকাব্যের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
মন্ত্র ও আধ্যাত্মিক শক্তি: মেঘনাদের যুদ্ধশক্তি ও মন্ত্রবলে মহাকাব্যের অতিপ্রাকৃত উপাদান প্রকাশ পেয়েছে।
৫. নায়ক ও প্রতিনায়কের নতুন ব্যাখ্যা:

প্রচলিত ধারার বিপরীতে দৃষ্টিভঙ্গি: মেঘনাদকে নায়ক ও রাম-লক্ষ্মণকে প্রতিপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করে মহাকাব্যের সাধারণ নিয়মে পরিবর্তন এনেছেন।
চরিত্রের গভীরতা: মেঘনাদের মানসিকতা, আদর্শ ও আত্মত্যাগের বর্ণনা চরিত্রগুলিকে মানবিক করে তুলেছে।
৬. নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ:

ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন: কাব্যে বিজেতা ও পরাজিতার মধ্যে নৈতিকতার প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যা মহাকাব্যের গভীরতা বৃদ্ধি করে।
মানবিক আবেগের চিত্রায়ণ: পিতা-পুত্রের সম্পর্ক, প্রেম, আত্মত্যাগ ইত্যাদি আবেগময় বিষয়গুলি মহাকাব্যের অন্তর্গত।
৭. যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা:

যুদ্ধের দৃশ্যায়ন: মহাকাব্যের মতই যুদ্ধের বর্ণনা বিশদ ও নাটকীয়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
নাটকীয়তা ও উত্তেজনা: যুদ্ধের কৌশল, অস্ত্রের ব্যবহার ও সংঘর্ষের চিত্রায়ণ পাঠকদের আকৃষ্ট করে।
৮. আন্তর্জাতিক মহাকাব্যের প্রভাব:

পাশ্চাত্য মহাকাব্যের ছাঁচ: হোমারের ‘ইলিয়াড’ ও মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ এর প্রভাব কাব্যে পরিলক্ষিত হয়।
মিশ্র শৈলী: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যের সমন্বয় করে নতুন ধারার সৃষ্টি।
৯. আদি ও উপসংহারের বর্ণনা:

মাঙ্গলিক সূচনা: দেবতার বন্দনা ও কাব্যের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে মহাকাব্যের রীতি অনুসরণ করা হয়েছে।
উপসংহার: কাহিনীর শেষে নৈতিক শিক্ষা ও পাঠকের জন্য বার্তা প্রদান করা হয়েছে।
১০. সংস্কৃত কাব্যের অনুসরণ:

প্রভাব: কালিদাস, ভাস প্রমুখ সংস্কৃত কবির মহাকাব্যের প্রভাব মধুসূদনের কাব্যে দেখা যায়।
শব্দচয়ন ও বাক্যগঠন: সংস্কৃত ব্যাকরণ ও শব্দের প্রয়োগ কাব্যের গাম্ভীর্য বৃদ্ধি করেছে।
উপসংহার:
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’ মহাকাব্যিক রীতি অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। প্রাচীন মহাকাব্যের গঠন, ভাষা, বিষয়বস্তু ও শৈলীকে অনুসরণ করে, তিনি বাংলায় আধুনিক মহাকাব্য রচনা করেছেন। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য মহাকাব্যের সমন্বয়ে কাব্যটি বাংলা সাহিত্যে একটি স্থায়ী ও মহৎ স্থান অধিকার করেছে। তাঁর এই সৃষ্টিশীলতা বাংলা সাহিত্যে মহাকাব্যের ধারাকে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় করেছে।

মুহাম্মদ ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024

বিভাগসমূহ