বাংলা নাটকের বিকাশ ও বর্তমান অবস্থা কী? বাংলা নাটকের বিকাশ ও বর্তমান অবস্থা কী?

0

বাংলা নাটকের বিকাশ ও বর্তমান অবস্থা কী?

আহমেদ রুসেল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024
0

বাংলা নাটকের ইতিহাস সমৃদ্ধ ও বহুমাত্রিক, যা প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিকাশ লাভ করেছে। বাংলা নাটকের বিকাশকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়: প্রাক-আধুনিক, আধুনিক, এবং সমকালীন।

প্রাক-আধুনিক যুগ

লোকনাট্য ও যাত্রাপালা: বাংলা নাটকের শিকড় লোকসংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত। গ্রামীণ বাংলায় লোকনাট্য, যাত্রাপালা, এবং পালাগান প্রচলিত ছিল। এসব নাট্যরূপে ধর্মীয় কাহিনী, পৌরাণিক গল্প, এবং সামাজিক বার্তা পরিবেশন করা হতো। যেমন, গম্ভীরা, কবিগান, আলকাপ, এবং বাউল গান।

আধুনিক যুগ (১৯শ থেকে ২০শ শতাব্দী)

কলকাতা ও শহুরে নাট্যচর্চা: ১৮৩১ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘হিন্দু থিয়েটার’, যা বাংলা নাটকের আধুনিক যুগের সূচনা করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম বাংলা নাটক “শর্মিষ্ঠা” রচনা করেন ১৮৫৯ সালে। এরপর গিরিশচন্দ্র ঘোষ, দীনবন্ধু মিত্র, এবং অমৃতলাল বসুর মতো নাট্যকাররা বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করেন।

দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ”: ১৮৬০ সালে প্রকাশিত “নীলদর্পণ” নাটকটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী প্রতিবাদ এবং কৃষকদের দুর্দশার প্রতিচ্ছবি। এই নাটক বাংলা সাহিত্যে একটি মাইলফলক।

গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও পেশাদার থিয়েটার: গিরিশচন্দ্র ঘোষ ‘স্টার থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলা নাটকে পেশাদারিত্বের সূচনা করেন। তাঁর লেখা “বিল্বমঙ্গল”, “সিরাজউদ্দৌলা” এবং “চৈতন্যলীলা” উল্লেখযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা নাটকে নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তাঁর রচিত “রাজা”, “ডাকঘর”, “রক্তকরবী”, এবং “তাসের দেশ” নাটকগুলি প্রতীকী এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত।

সমকালীন যুগ (২০শ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে বর্তমান)

নাট্য আন্দোলন ও গ্রুপ থিয়েটার: ১৯৪০-৫০-এর দশকে গ্রুপ থিয়েটারের আন্দোলন শুরু হয়। উৎপল দত্ত, শম্ভু মিত্র, এবং বিজন ভট্টাচার্যের মতো নাট্যব্যক্তিত্বরা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করেন।

বিজন ভট্টাচার্যের “নবান্ন”: “নবান্ন” নাটকটি বাংলার দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত, যা সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরে।

উৎপল দত্ত ও গণনাট্য সংঘ: উৎপল দত্তের নেতৃত্বে গণনাট্য সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা নাটককে সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাঁর রচিত “কল্লোল”, “টিনের তলোয়ার” প্রভৃতি নাটক সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতনতার প্রতিফলন।

আধুনিক নাট্যচর্চা: ১৯৭০-এর দশক থেকে বাংলা নাটকে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। বাদল সরকার তাঁর ‘থার্ড থিয়েটার’ আন্দোলনের মাধ্যমে নাটককে প্রথাগত মঞ্চ থেকে বের করে আনেন। তাঁর “এভাম্ ইন্দ্রজিৎ”, “পাগলা ঘোড়া” প্রভৃতি নাটক নতুন শৈলীর উদাহরণ।

বাংলা নাটকের বর্তমান অবস্থা
মঞ্চ নাটক

বৈচিত্র্য ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা: বর্তমানে বাংলা নাটক বিষয়বস্তু, শৈলী এবং উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময়। সমকালীন নাট্যকাররা সামাজিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং অস্তিত্বমূলক বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।

নতুন নাট্যদল ও উৎসব: ঢাকা ও কলকাতায় নতুন নতুন নাট্যদল গড়ে উঠছে। নাট্য উৎসব, যেমন ‘জাতীয় নাট্যোৎসব’, ‘বাংলা নাট্য মেলা’ ইত্যাদি নাট্যচর্চাকে উৎসাহিত করছে।

টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়া

টেলিনাটক ও ধারাবাহিক: বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে টেলিভিশনে নাটক ও ধারাবাহিকের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। এগুলিতে সামাজিক সমস্যা, পারিবারিক গল্প এবং প্রেমের কাহিনী তুলে ধরা হয়।

ওয়েব সিরিজ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: ডিজিটাল যুগে ওয়েব সিরিজ ও অনলাইন নাটকের উত্থান ঘটেছে। যুব প্রজন্মের নির্মাতারা নতুন ধারণা ও শৈলী নিয়ে কাজ করছেন।

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

আর্থিক সীমাবদ্ধতা: মঞ্চ নাটক আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর ঘাটতি নাট্যচর্চাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা: পেশাদার নাট্যকার, নির্দেশক এবং অভিনেতার ঘাটতি রয়েছে। তবে নাট্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মশালার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা চলছে।

দর্শক আকর্ষণ: টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতিযোগিতায় মঞ্চ নাটককে দর্শক আকর্ষণ করতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নতুন ও সৃজনশীল উপস্থাপনার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা হচ্ছে।

উপসংহার
বাংলা নাটক তার দীর্ঘ ইতিহাসে বিভিন্ন পর্যায়ে বিকাশ লাভ করেছে এবং সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে নাটক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও সৃজনশীলতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এবং নতুন প্রজন্মের আগমনে বাংলা নাটকের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করার মাধ্যমে বাংলা নাটক আগামী দিনেও তার স্বকীয়তা বজায় রাখবে।

আহমেদ রুসেল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024

বিভাগসমূহ