চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য কী?

0

চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য কী?

আহমেদ রুসেল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024
0

চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল (Chittagong Hill Tracts) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি বিশেষ ভৌগোলিক এলাকা। এটি দেশের একমাত্র উল্লেখযোগ্য পাহাড়ি অঞ্চল এবং তার ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের জন্য পরিচিত। নিচে চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের প্রধান ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:

১. অবস্থান ও সীমানা

অবস্থান: চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত, যা চট্টগ্রাম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত।
সীমানা: এর পূর্বে মিয়ানমার (বার্মা), উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্য, পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলা এবং দক্ষিণে কক্সবাজার জেলা অবস্থিত।
২. প্রশাসনিক বিভাজন

চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল তিনটি জেলায় বিভক্ত:
রাঙ্গামাটি জেলা
খাগড়াছড়ি জেলা
বান্দরবান জেলা
৩. ভূপ্রকৃতি ও ভূতত্ত্ব

পাহাড় ও পর্বতশ্রেণী: এই অঞ্চলটি ছোট থেকে মাঝারি উচ্চতার পাহাড় ও পর্বতশ্রেণী নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ সাকা হাফং (প্রায় ১,০৫২ মিটার) বান্দরবান জেলায় অবস্থিত।
উপত্যকা ও প্লেটো: পাহাড়গুলোর মধ্যে উপত্যকা এবং সমতল প্লেটো রয়েছে, যা কৃষি ও বসতির জন্য ব্যবহৃত হয়।
মাটির গঠন: পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি সাধারণত লালচে এবং পাথুরে ধরনের, যা স্থানীয় উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য উপযোগী।
৪. নদীনালা ও জলাধার

কর্ণফুলী নদী: এই অঞ্চলের প্রধান নদী কর্ণফুলী, যা রাঙ্গামাটি জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।
কাপ্তাই হ্রদ: কর্ণফুলী নদীর ওপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্টি হয়েছে কাপ্তাই হ্রদ, যা বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার।
সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদী: বান্দরবান জেলার মধ্য দিয়ে সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদী প্রবাহিত হয়, যা কৃষি ও মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ।
৫. জীববৈচিত্র্য ও বনাঞ্চল

বনাঞ্চল: এই অঞ্চলে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় চিরসবুজ বন, অর্ধ-চিরসবুজ বন এবং বৃষ্টি অরণ্য রয়েছে। প্রধান গাছপালার মধ্যে রয়েছে সেগুন, গর্জন, চাপালিশ, তেলসুর প্রভৃতি।
বন্যপ্রাণী: এখানে হাতি, বাঘ, মায়া হরিণ, গাউর, বানর, গিবন, এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ পাওয়া যায়।
প্রকৃতি সংরক্ষণ: বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য এখানে বিভিন্ন অভয়ারণ্য ও জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৬. আবহাওয়া ও জলবায়ু

আবহাওয়া: উষ্ণ ও আর্দ্র ক্রান্তীয় জলবায়ু। বর্ষাকালে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
তাপমাত্রা: গড় তাপমাত্রা ১৩°C থেকে ৩০°C এর মধ্যে পরিবর্তিত হয়।
বৃষ্টিপাত: বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ২০০০ মিমি থেকে ৩০০০ মিমি।
৭. সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য

উপজাতি ও সম্প্রদায়: চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, বমসহ ১১টিরও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায় বসবাস করে।
ভাষা ও সংস্কৃতি: প্রতিটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক, এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে।
হস্তশিল্প: স্থানীয়রা হাতে তৈরি বস্ত্র, বাঁশ ও বেতের পণ্য, এবং কাঠের নকশার জন্য পরিচিত।
৮. কৃষি ও অর্থনীতি

জুম চাষ: পাহাড়ি ঢালুতে স্থানান্তরিত কৃষি পদ্ধতি ‘জুম’ চাষ প্রচলিত। ধান, শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদন করা হয়।
বাণিজ্যিক ফসল: রাবার, কফি, কাকাও, আদা, হলুদের মতো বাণিজ্যিক ফসল চাষ করা হয়।
মৎস্য সম্পদ: কাপ্তাই হ্রদ ও নদীগুলো মৎস্য উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৯. পর্যটন সম্ভাবনা

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, এবং বনের মিশ্রণে এই অঞ্চল পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
পর্যটন স্থান: সাজেক ভ্যালি, নীলগিরি, কেওক্রাডং, বগালেক, নাফাখুম ঝর্ণা প্রভৃতি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
সাংস্কৃতিক পর্যটন: আদিবাসী সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও উৎসব পর্যটনকে সমৃদ্ধ করে।
১০. প্রকৃতিগত চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা

ভূমিধস: অতিবৃষ্টির ফলে ভূমিধসের ঝুঁকি থাকে, যা জীবনযাত্রা ও অবকাঠামোর জন্য হুমকি।
বন ধ্বংস: অতিরিক্ত বনকাটা ও জুম চাষের ফলে বনাঞ্চল হ্রাস পাচ্ছে, যা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর।
পরিবেশগত সমস্যা: বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল সংকুচিত হওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।
উপসংহার
চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চল বাংলাদেশের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। এর পাহাড়ি ভূপ্রকৃতি, সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যথাযথ সংরক্ষণ ও উন্নয়নের মাধ্যমে এই অঞ্চলের সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে অবদান রাখা সম্ভব।

আহমেদ রুসেল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024

বিভাগসমূহ