রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শন কী ছিল?

0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শন কী ছিল?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 7 দিন পূর্বে
0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক মহীরুহ, কবি, দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং শিক্ষাবিদ। তিনি শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রবর্তন করেন, যা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে শিক্ষার্থীদের মানসিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশকে গুরুত্ব দেয়। তাঁর শিক্ষা দর্শন ছিল মানবিকতা, সৃজনশীলতা, প্রকৃতির সাথে সংযোগ এবং সর্বজনীনতার উপর ভিত্তি করে।

মূলনীতি ও বৈশিষ্ট্য
১. প্রকৃতির মধ্যে শিক্ষা

প্রকৃতির সান্নিধ্য: রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃতির সাথে সংযোগ শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে সহায়ক। তিনি কংক্রিটের ঘরের পরিবর্তে খোলা আকাশের নিচে শিক্ষাদানকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
পরিবেশবান্ধব শিক্ষা: শিক্ষার্থীরা প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রহস্য অন্বেষণ করে জ্ঞান অর্জন করবে।
২. সৃজনশীলতা ও শিল্পকলার গুরুত্ব

কলা ও সঙ্গীতের ভূমিকা: সঙ্গীত, চিত্রকলা, নৃত্য ইত্যাদি শিল্পকলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও মানসিক বিকাশ সম্ভব।
স্বাধীন চিন্তাধারা: সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে উৎসাহিত করা।
৩. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা

স্বতন্ত্র বিকাশ: প্রতিটি শিক্ষার্থীর নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, যা শিক্ষার মাধ্যমে বিকশিত হবে।
বাধ্যবাধকতার বিরোধিতা: কঠোর নিয়ম ও শৃঙ্খলার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশের সুযোগ প্রদান।
৪. শিখন প্রক্রিয়ায় আনন্দ

আনন্দময় শিক্ষা: শিক্ষাকে আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় করা, যাতে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী হয়।
মুখস্থবিদ্যার বিরোধিতা: মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে বোঝাপড়া ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিক্ষাদান।
৫. সর্বজনীনতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব

বিশ্বমানবতার ধারণা: শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশ্বজনীন চেতনা ও মানবতার বোধ জাগিয়ে তোলা।
পূর্ব ও পশ্চিমের সমন্বয়: পূর্বের আধ্যাত্মিকতা ও পশ্চিমের বিজ্ঞানচেতনার সমন্বয়ে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৬. সমাজসেবা ও কর্মমুখী শিক্ষা

সমাজের সাথে সংযোগ: শিক্ষার্থীরা যাতে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে সেই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা।
কর্মের মাধ্যমে শিক্ষা: তত্ত্ব ও বাস্তবজীবনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে কর্মমুখী শিক্ষা প্রদান।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম
শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

শান্তিনিকেতন (১৯০১): পশ্চিমবঙ্গের বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা প্রকৃতির মাঝে একটি আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯২১): পরে এটি ‘বিশ্বভারতী’ নামে আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়, যেখানে বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
শিক্ষাদানের পদ্ধতি:
আবাসিক ব্যবস্থা: শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সাথে একত্রে বসবাস করে, যা গুরু-শিষ্য সম্পর্ককে মজবুত করে।
খোলা আকাশের নিচে ক্লাস: গাছের নিচে বা খোলা প্রাঙ্গণে ক্লাস নেওয়া হয়, যা প্রকৃতির সাথে সংযোগ স্থাপন করে।
বহুভাষিক শিক্ষা: বাংলা, সংস্কৃত, ইংরেজি সহ অন্যান্য ভাষার শিক্ষা প্রদান।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: বার্ষিক উৎসব, নাটক, সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক বিকাশ।
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা
বস্তাপচা শিক্ষাব্যবস্থা: রবীন্দ্রনাথ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কঠোর নিয়ম, মুখস্থবিদ্যা ও সৃজনশীলতার অভাবের সমালোচনা করেন।
শিক্ষার্থীর মানসিক চাপ: পরীক্ষার চাপ ও প্রতিযোগিতার কারণে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয় বলে তিনি মনে করতেন।
মানুষ গড়ার শিক্ষা: তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা কেবল পেশাগত দক্ষতা নয়, বরং সম্পূর্ণ মানুষ গড়ার মাধ্যম।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রভাব: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা দর্শন আধুনিক শিক্ষাবিদ ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রভাবিত করেছে।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: বিশ্বভারতী আন্তর্জাতিক শিক্ষাঙ্গনে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন: তাঁর দর্শন শিক্ষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে।
উপসংহার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা দর্শন ছিল মানবিক মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা, প্রকৃতির সাথে সংযোগ এবং বিশ্বজনীনতার উপর প্রতিষ্ঠিত। তিনি শিক্ষাকে আনন্দময় ও অর্থবহ করে তোলার প্রচেষ্টা করেছেন, যা শিক্ষার্থীদের মানসিক ও আত্মিক বিকাশে সহায়ক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর শিক্ষা দর্শনের জীবন্ত প্রতীক, যা আজও শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের প্রেরণা জোগায়। তাঁর এই দর্শন ভবিষ্যতেও শিক্ষার ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রাখবে।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 7 দিন পূর্বে

বিভাগসমূহ