বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা কী?
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই যুদ্ধে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, মানবিক এবং সামরিক সহায়তার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
ভারতের ভূমিকা
১. মানবিক সহায়তা
শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান:
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার ও গণহত্যার ফলে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেয়।
ভারত সরকার শরণার্থীদের জন্য সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে শিবির স্থাপন করে, যেখানে খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনে ভারতের সাধারণ জনগণও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
২. রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন
বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি:
৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জোগাড়ে সহায়ক হয়।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে সমর্থন আদায়:
ভারত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কথা তুলে ধরে।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টা চালায়।
৩. সামরিক সহায়তা
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ:
ভারত বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীকে শক্তিশালী করা হয়।
সরাসরি সামরিক অভিযান:
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১, পাকিস্তান ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়, যা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা করে।
ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ শুরু করে।
ভারতীয় স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।
পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ:
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ভারতীয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন।
এই আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়।
৪. কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রম
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি:
ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি (আগস্ট ১৯৭১) স্বাক্ষরিত হয়, যা কূটনৈতিকভাবে ভারতকে সমর্থন জোগাড়ে সহায়ক হয়।
জাতিসংঘে ভূমিকা:
জাতিসংঘে ভারত পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে।
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলি বিবেচনা করে ভারতের অবস্থান ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে যুদ্ধবিরতি না করা।
৫. মানবিক ও পুনর্বাসন সহায়তা
যুদ্ধ পরবর্তী সহায়তা:
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভারত বাংলাদেশকে পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনে সহায়তা করে।
অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ, খাদ্য সরবরাহ, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদিতে সাহায্য প্রদান করে।
শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন:
যুদ্ধ শেষে শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরে যায়, যেখানে ভারতের সহায়তায় তাদের পুনর্বাসন করা হয়।
ভারতের ভূমিকার প্রভাব ও গুরুত্ব
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত করা:
ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপ পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ত্বরান্বিত করে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন বৃদ্ধি:
ভারতের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন বাড়ায়।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন:
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করে, যা আজও বিদ্যমান।
মানবিক মূল্যবোধের উদাহরণ:
শরণার্থীদের আশ্রয় ও সহায়তা প্রদান মানবিক মূল্যবোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়।
উপসংহার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল বহুমুখী ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানবিক সহায়তা, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ, এবং সরাসরি সামরিক অভিযানের মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অপরিসীম অবদান রেখেছে। এই সহযোগিতা দুই দেশের মধ্যে গভীর সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছে, যা ভবিষ্যতেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবে।
স্মরণীয়: ভারতের এই সহায়তা ও ভূমিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে, যা দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যের প্রতীক।