১৯৭১ সালে জাতিসংঘের ভূমিকা কী ছিল?
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট, তবে এটি অনেক বিতর্কের বিষয়ও বটে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের কর্মকাণ্ড এবং তার প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া কিছুটা ধীরগতিসম্পন্ন ছিল এবং যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারকে শক্তিশালী সমর্থন দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। নিচে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু প্রধান দিক তুলে ধরা হলো:
১. মানবিক সহায়তা:
যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়, যার ফলে বিশাল মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (UNHCR) এই শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদান করেছিল। ভারত সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে জাতিসংঘ শরণার্থীদের জন্য খাদ্য, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদান করে।
তবে জাতিসংঘের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষত নিরাপত্তা পরিষদ, এই শরণার্থী সংকটের জন্য পাকিস্তান সরকারকে সরাসরি দায়ী করতে প্রাথমিকভাবে তৎপর ছিল না।
২. সামরিক হস্তক্ষেপে প্রতিক্রিয়া:
ভারত যখন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তখন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এই বিষয়টি উঠে আসে। পাকিস্তান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলে এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়।
নিরাপত্তা পরিষদে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছিল, যা মূলত যুদ্ধবিরতির ওপর জোর দেয়। তবে জাতিসংঘ তখন যুদ্ধের মূল কারণ, যেমন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা এবং নির্যাতন, এ বিষয়ে কোনো তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
৩. নিরাপত্তা পরিষদে বিরোধিতা:
নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানের সমর্থক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন কাজ করেছিল। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলি ভারতের বিরুদ্ধে আসার সম্ভাবনা তৈরি করেছিল, কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকায়, এই প্রস্তাবগুলোতে ভেটো প্রদান করেছিল, যা জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রয়োগের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয়।
৪. গণহত্যার বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তা:
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) ব্যাপক গণহত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে। এসময় জাতিসংঘ সরাসরি এই গণহত্যা বন্ধে বা নিন্দা প্রকাশে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি। যদিও কিছু দেশের কূটনীতিক ও মানবাধিকার সংস্থা জাতিসংঘের কাছে এই গণহত্যা সম্পর্কে রিপোর্ট করেছিল, তবু জাতিসংঘ এ বিষয়ে কোনো বড় পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
৫. বাংলাদেশের স্বীকৃতি:
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়ের মাধ্যমে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে সদস্যপদ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব করেছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করলেও, জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ পেতে সময় লেগেছিল, কারণ কিছু প্রভাবশালী দেশ, বিশেষত চীন, শুরুতে বাংলাদেশের সদস্যপদে বাধা দিয়েছিল।
৬. জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য:
যুদ্ধের পরপরই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন ইউনিসেফ (UNICEF), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP), এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বাংলাদেশের পুনর্গঠন এবং উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুনর্গঠন কার্যক্রমে এই সংস্থাগুলো খাদ্য, চিকিৎসা, এবং অবকাঠামোগত সহায়তা প্রদান করে, যা যুদ্ধের পর বাংলাদেশের পুনর্গঠনে সহায়ক হয়েছিল।
৭. রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা:
যুদ্ধের সময় জাতিসংঘের কিছু কূটনীতিক এবং শান্তি-প্রিয় নেতারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে জাতিসংঘের এসব উদ্যোগ কোনো কার্যকর সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছিল, কারণ তখন পরিস্থিতি অত্যন্ত সংকটাপন্ন ছিল এবং উভয় পক্ষই তাদের অবস্থানে অনড় ছিল।
সারসংক্ষেপ:
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জাতিসংঘের ভূমিকা সীমাবদ্ধ এবং অনেকাংশে বিতর্কিত ছিল। মানবিক সহায়তায় কিছু ভূমিকা থাকলেও, জাতিসংঘ পাকিস্তানের সামরিক কার্যকলাপ ও গণহত্যার বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জাতিসংঘের মূলত নিরপেক্ষ অবস্থান এবং যুদ্ধের সময় কোনো কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলে মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তবে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।