বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ কী?

72 বার দেখাভূগোলউপকূল পরিবেশ বাংলাদেশ
0

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ কী?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 11, 2024
0

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, যার উপকূলীয় অঞ্চল প্রায় ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এই উপকূলীয় অঞ্চল বঙ্গোপসাগরের সাথে সংযুক্ত এবং দেশের মোট এলাকার প্রায় ৩২% জুড়ে রয়েছে। উপকূলীয় এলাকাগুলি অর্থনৈতিক, পরিবেশগত ও সামাজিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেগুলি বিভিন্ন পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

প্রধান পরিবেশগত চ্যালেঞ্জসমূহ
১. জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি:
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে মেরু অঞ্চল ও হিমবাহের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে।
অনুমান করা হয় যে আগামী কয়েক দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে, যা উপকূলীয় এলাকায় প্লাবনের ঝুঁকি বাড়াবে।
জলমগ্নতা ও ভূমি হারানো:
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে উপকূলীয় এলাকার নিম্নভূমি অঞ্চলগুলি জলমগ্ন হয়ে পড়ছে।
এটি কৃষি জমি, বসতি ও অবকাঠামোর ক্ষতি করে।
২. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস

প্রকোপ বৃদ্ধি:
বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি স্বাভাবিক ঘটনা, তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর তীব্রতা ও ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ক্ষয়ক্ষতি:
ঘূর্ণিঝড়ের ফলে জলোচ্ছ্বাস হয়, যা উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি করে।
উদাহরণস্বরূপ, সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), আম্পান (২০২০) প্রভৃতি ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বিশাল ক্ষতি হয়েছে।
৩. লবণাক্ততার বৃদ্ধি

মাটির লবণাক্ততা:
সমুদ্রের জল স্থলভাগে প্রবেশ করে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি করে।
এর ফলে কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পায়, যা কৃষকদের জীবিকায় প্রভাব ফেলে।
পানীয় জলের সংকট:
লবণাক্ততার কারণে সুপেয় জলের উৎস দূষিত হয়, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
৪. উপকূলীয় ক্ষয় ও ভাঙন

নদী ও সমুদ্রের ভাঙন:
উপকূলীয় এলাকার নদী ও সমুদ্রের স্রোতের পরিবর্তনের কারণে ভূমিক্ষয় ঘটে।
অনেক বাসস্থান ও জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
বাঁধ ও অবকাঠামোর ক্ষতি:
উপকূলীয় বাঁধ ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা সুরক্ষার অভাব সৃষ্টি করে।
৫. জীববৈচিত্র্যের হ্রাস

সুন্দরবন ও ম্যানগ্রোভ বন:
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত।
জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা ও মানবসৃষ্ট কার্যক্রমের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে।
প্রজাতির বিলুপ্তি:
কুমির, বাঘ, হরিণ প্রভৃতি প্রজাতির আবাসস্থল হ্রাস পাচ্ছে।
৬. মৎস্যসম্পদের হ্রাস

অতিরিক্ত মাছ ধরার প্রভাব:
অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত মাছ ধরা মৎস্যসম্পদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
জল দূষণ:
শিল্পবর্জ্য, তেল ও রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ জল দূষণ করে, যা মৎস্যসম্পদ ও সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে।
৭. বন্যা ও প্লাবন

প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
বন্যা ও প্লাবন উপকূলীয় এলাকায় সাধারণ ঘটনা, যা জীবিকা ও সম্পদের ক্ষতি করে।
জল নিষ্কাশনের অভাব:
পর্যাপ্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় জল জমে থাকে, যা কৃষি ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে।
৮. জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণ

জনসংখ্যার চাপ:
উপকূলীয় এলাকায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সম্পদ ও পরিষেবার ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ:
অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৯. ভূমি ব্যবহার পরিবর্তন

কৃষি থেকে চিংড়ি চাষে রূপান্তর:
অধিক লাভের আশায় কৃষিজমি চিংড়ি চাষের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে, যা মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে।
বন উজাড়:
জ্বালানি, কাঠ ও কৃষির জন্য বন উজাড় করা হচ্ছে, যা মাটিক্ষয় ও পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে।
১০. জলবাহিত রোগ ও স্বাস্থ্য সমস্যা

স্বাস্থ্যঝুঁকি:
লবণাক্ততা ও জল দূষণের কারণে ডায়রিয়া, কলেরা ও চর্মরোগের মতো জলবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্যানিটেশন ও সুপেয় জলের অভাব:
পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও সুপেয় জলের অভাব জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
সমাধান ও উদ্যোগ
সরকারি ও বেসরকারি পদক্ষেপ

বাঁধ ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ:
উপকূলীয় এলাকায় সাইক্লোন শেল্টার, বাঁধ ও বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ।
ম্যানগ্রোভ বনায়ন:
উপকূলীয় এলাকায় ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরোপণ করে প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা।
লবণ সহনশীল ফসলের প্রচলন:
লবণাক্ত জমিতে চাষের উপযোগী ফসলের উন্নয়ন ও প্রচলন।
বৃষ্টির জল সংরক্ষণ ও সুপেয় জলের ব্যবস্থা:
বৃষ্টির জল সংরক্ষণ, গভীর নলকূপ স্থাপন ও পানীয় জলের সরবরাহ নিশ্চিত করা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলা:
জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমন কৌশল গ্রহণ।
সচেতনতা ও শিক্ষা

কমিউনিটি প্রশিক্ষণ:
স্থানীয় জনগণকে পরিবেশগত ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা ও প্রশিক্ষণ প্রদান।
শিক্ষা ও গবেষণা:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষা কার্যক্রম।
উপসংহার
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ বহুমুখী ও জটিল। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা ও মানবসৃষ্ট কার্যক্রমের ফলে এই চ্যালেঞ্জগুলি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহার, জনগণের অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। উপকূলীয় এলাকার পরিবেশ সুরক্ষা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যাবে।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 11, 2024

বিভাগসমূহ