ভারতের ‘নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট’-এ অংশগ্রহণের কারণ কী?

21 বার দেখারাজনীতিভারত
0

ভারতের ‘নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট’-এ অংশগ্রহণের কারণ কী?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
0

ভারতের ‘নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট’ (NAM) বা জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে অংশগ্রহণের পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। এই আন্দোলন ছিল তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক ধরনের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ, যেখানে কোনো দেশ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা ব্লক বা সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্লকের অংশ না হয়ে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করত। ভারত, বিশেষ করে এর প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, এই জোটনিরপেক্ষ নীতির অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন।

নিচে ভারতের নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্টে অংশগ্রহণের কারণগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

১. স্নায়ুযুদ্ধের প্রেক্ষাপট:
ভারত যখন ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের দ্বন্দ্বে বিভক্ত ছিল। দুটি প্রধান শক্তি, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন, বিশ্বকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছিল। এই দ্বন্দ্বময় পরিস্থিতিতে ভারত কোনো একটি ব্লকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে চায়নি, কারণ এটি স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে চেয়েছিল।

কারণ: স্নায়ুযুদ্ধের সময় কোনো একটি শক্তির অধীনে না থেকে ভারতের জন্য একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করা ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর ফলে ভারত নিজস্ব স্বার্থ বজায় রেখে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারত।
২. আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রচারণা:
ভারত, বিশেষ করে নেহেরু, আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন। ভারত চেয়েছিল বিশ্বে শীতল যুদ্ধের উত্তেজনা কমানো এবং একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য কোনো বড় শক্তির সঙ্গে সামরিকভাবে জড়িয়ে না পড়ে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মাধ্যমে শান্তির বার্তা প্রচার করা হয়।

কারণ: যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং শান্তির পক্ষে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান ভারতের বৈদেশিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল।
৩. ঔপনিবেশিকতার বিরোধিতা:
ভারত নিজেই একটি দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে। সুতরাং, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে অন্য দেশগুলোর ওপর ঔপনিবেশিক দখলের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা স্বাভাবিক ছিল। নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভারত এই বার্তা দিতে চেয়েছিল যে, কোনো দেশের ওপর বড় শক্তিগুলোর আধিপত্য থাকা উচিত নয়।

কারণ: ভারত বিশ্বের নতুন স্বাধীন দেশগুলোর জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করতে চেয়েছিল, যারা কোনো শক্তির আধিপত্যে না থেকে তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চায়।
৪. উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিত্ব:
নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্টে অংশগ্রহণ করে ভারত মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোর কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, অনেক নতুন স্বাধীন দেশ অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে দুর্বল ছিল এবং তারা কোনো ব্লকের অধীনে না থেকে তাদের নিজস্ব পথ খুঁজতে চেয়েছিল। ভারত এই দেশগুলোর জন্য একটি নেতৃত্বশীল ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিল।

কারণ: ভারত চেয়েছিল, উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের নিজস্ব স্বার্থে কাজ করবে এবং বড় শক্তির চাপে পড়ে তাদের স্বাধীনতা বিসর্জন দেবে না।
৫. ভারতের স্বার্থ রক্ষা:
ভারত নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্টে অংশ নিয়ে তার নিজস্ব কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিল। এটি ভারতের জন্য একটি সুযোগ ছিল যাতে দেশটি স্বাধীনভাবে বিভিন্ন দেশ বা শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারে এবং বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে পারে। ভারত চেয়েছিল তার সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রেখে স্বাধীনভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে অংশ নিতে।

কারণ: ভারত বড় শক্তিগুলোর প্রভাবমুক্ত থেকে তার স্বার্থ রক্ষা করতে চেয়েছিল এবং স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিল।
৬. এশিয়া ও আফ্রিকার নেতৃত্বে ভূমিকা:
ভারত নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্টের মাধ্যমে এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে একটি নেতৃত্বশীল ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিল। নেহেরু চেয়েছিলেন, এশিয়া ও আফ্রিকার নতুন স্বাধীন দেশগুলো একসঙ্গে একটি নিরপেক্ষ কৌশল গ্রহণ করবে, যা তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য সহায়ক হবে।

কারণ: ভারত এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে জোটনিরপেক্ষতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিল এবং নিজেকে এই অঞ্চলের একটি নেতৃস্থানীয় দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল।
৭. সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আদর্শের ভারসাম্য:
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ছিল সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক আদর্শের একটি মিশ্রণ। নেহেরু চেয়েছিলেন, ভারত তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করবে, যা উভয় আদর্শের প্রতি সমর্থন প্রদর্শন করবে।

কারণ: ভারত চেয়েছিল গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তৈরি করতে।
৮. পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ এবং শান্তির জন্য প্রচারণা:
নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্টে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভারত পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার জন্য প্রচারণা চালাতে পেরেছিল। নেহেরু বরাবরই চেয়েছিলেন বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ হবে এবং এটি বড় শক্তির হাতে কেবলমাত্র ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে না।

কারণ: পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে অবস্থান এবং বিশ্বে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারত এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল।
সারসংক্ষেপ:
ভারতের ‘নন অ্যালাইন্ড মুভমেন্ট’-এ অংশগ্রহণের মূল কারণ ছিল স্নায়ুযুদ্ধের জটিলতা থেকে দূরে থেকে স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা, আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা, এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতৃত্ব দেওয়া। ভারত কোনো বড় শক্তির অধীনে না থেকে সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে নিজের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে

বিভাগসমূহ