বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিতে কী প্রভাব পড়ছে?

0

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিতে কী প্রভাব পড়ছে?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
0

বাংলাদেশের কৃষি খাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গভীর এবং বহুমুখী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, এবং ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও খরার মতো চরম আবহাওয়া পরিস্থিতি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সকল পরিবেশগত পরিবর্তন দেশের কৃষি খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

নিচে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষিতে কী কী প্রভাব পড়ছে তা বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:

১. খরা ও শুষ্ক মৌসুমে ক্ষয়ক্ষতি:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে খরার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে খরার কারণে জমির আর্দ্রতা কমে যাচ্ছে, যা ফসল উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর।

ধান, গম, এবং অন্যান্য ফসলের জন্য পর্যাপ্ত পানি না থাকায় উৎপাদন কমে যায়। খরার কারণে মাটির উর্বরতাও কমে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
২. বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে ফসলহানি:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের ধরণে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। অতিবৃষ্টি এবং অনিয়মিত বৃষ্টি ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতিবৃষ্টির ফলে বন্যা এবং নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে ফসলের মাঠ প্লাবিত হয়।

বিশেষ করে বর্ষাকালে ধান, পাট, এবং শাকসবজি চাষ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বন্যার কারণে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি হয় এবং অনেক ক্ষেত্রেই ফসল পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়।
৩. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রের নোনা পানি উপকূলীয় কৃষি জমিতে প্রবেশ করছে এবং জমির লবণাক্ততা বাড়ছে।

এই লবণাক্ততা ফসলের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের ধান এবং অন্যান্য ফসলের চাষাবাদে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। লবণাক্ত পানির কারণে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে এবং উপকূলীয় কৃষকরা ফসল উৎপাদনে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন।
৪. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব:
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা এবং সংখ্যা বেড়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে কৃষিজমি ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং কৃষকরা ফসলের বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছেন।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান, সিডর এবং আইলার মতো দুর্যোগ উপকূলীয় এলাকায় কৃষি জমিতে নোনা পানি ঢুকিয়ে ফসল ধ্বংস করেছে, যার ফলে উপকূলীয় কৃষকেরা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
৫. উচ্চ তাপমাত্রার প্রভাব:
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রার বৃদ্ধি কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাপমাত্রা বেশি হলে অনেক ফসলের উৎপাদনশীলতা কমে যায়। বিশেষ করে, ধানের মতো তাপ-সংবেদনশীল ফসলগুলো উচ্চ তাপমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় ফসলের গুণগত মান এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। তাপমাত্রার বৃদ্ধি ফসলের রোগবালাই বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখছে।
৬. জলাবদ্ধতার সমস্যা:
বৃষ্টির সময় অস্বাভাবিকভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, বিশেষ করে দেশের নিম্নাঞ্চলে। জলাবদ্ধতার ফলে ধান, পাট, এবং অন্যান্য ফসল জমির নিচে ডুবে যায় এবং ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

জলাবদ্ধতার কারণে মাটির গঠন পরিবর্তিত হয়, এবং এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদে জমি কৃষিকাজের জন্য অনুপযোগী হয়ে উঠতে পারে।
৭. পোকামাকড় ও রোগবালাই বৃদ্ধি:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন পোকামাকড় এবং রোগবালাই বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পরিবর্তনের ফলে কিছু বিশেষ ধরনের কীটপতঙ্গ এবং ছত্রাকের আক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ফসলের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

ধান, গম, সবজি এবং ফলমূলের ক্ষেত্রে রোগবালাই বাড়ার ফলে ফসলের গুণগত মান এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
৮. কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। অনিয়মিত বৃষ্টি, খরা, লবণাক্ততা, এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে জমির উর্বরতা এবং কৃষকের উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

৯. নতুন প্রজাতির ফসলের চাহিদা:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সহনশীল ফসলের প্রয়োজন বাড়ছে। বাংলাদেশ সরকার এবং কৃষি বিজ্ঞানীরা জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের দিকে জোর দিচ্ছেন। বিশেষ করে, লবণাক্ততা এবং খরা সহনশীল ধান ও অন্যান্য ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা চলছে।

সারসংক্ষেপ:
বাংলাদেশের কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ব্যাপক এবং বহুমুখী। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, খরা, বন্যা, লবণাক্ততা, এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কৃষকরা চরম দুর্দশার মধ্যে আছেন। কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তার ওপরও এর প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে টেকসই কৃষি প্রযুক্তি এবং সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনই এ সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024

বিভাগসমূহ