বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সমস্যা কেন হচ্ছে?

0

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সমস্যা কেন হচ্ছে?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
0

বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সমস্যা একটি জটিল ও ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সমস্যা, যা বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি, মৎস্যচাষ, এবং জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। লবণাক্ততা সমস্যার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর পানি প্রবাহে বাঁধ, এবং অসংগত নদী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত।

নিচে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের নোনা পানি নদী ও খালে প্রবেশ করছে এবং তা ধীরে ধীরে মাটিতে মিশে গিয়ে লবণাক্ততা বাড়াচ্ছে।

সমুদ্রের নোনা পানি ভূমিতে ঢুকে কৃষিজমি, পুকুর, এবং অন্যান্য জলাধারের পানিকে লবণাক্ত করে তুলছে, যা চাষাবাদ এবং মিঠা পানির মাছের চাষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
২. নদীতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া:
বাংলাদেশের অনেক উপকূলীয় এলাকা নদী-নালার ওপর নির্ভরশীল। তবে শুষ্ক মৌসুমে নদীতে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে গেলে সমুদ্রের নোনা পানি নদী এবং জলাধারগুলোতে প্রবেশ করে। ভারতের সঙ্গে কিছু নদীর পানিবণ্টন চুক্তির অভাবে শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা, পদ্মা, এবং অন্যান্য নদীর পানির প্রবাহ কমে যায়, ফলে নোনা পানি আরও ভেতরের দিকে প্রবেশ করে।

বিশেষ করে ফারাক্কা বাঁধ এবং অন্যান্য বাঁধের কারণে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
৩. জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়:
বাংলাদেশ উপকূলীয় এলাকা বারবার জলোচ্ছ্বাস এবং ঘূর্ণিঝড়ের সম্মুখীন হয়, যা নোনা পানি ঢুকে পড়ার একটি বড় কারণ। ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় সমুদ্রের পানি উপকূলীয় এলাকায় প্রবল বেগে প্রবেশ করে এবং জলাভূমি, পুকুর, ও কৃষিজমিতে নোনা পানি জমা হয়, যা লবণাক্ততার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, এবং আম্পান এর মতো দুর্যোগের সময় উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং চাষাবাদ ও মাছ চাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
৪. জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিরিক্ত বৃষ্টি:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে। অতিরিক্ত বৃষ্টি বা অনিয়মিত বৃষ্টির ফলে উপকূলীয় এলাকায় মাটি ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা এবং বৃষ্টির পরিবর্তনশীলতা মাটিতে লবণাক্ততার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মাটির উর্বরতা কমে যাচ্ছে এবং লবণাক্ততা বাড়ার ফলে কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে।
৫. অসচেতন নদী ব্যবস্থাপনা ও পোল্ডার নির্মাণ:
বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণে পোল্ডার বা বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, যা জমিতে নোনা পানি প্রবেশ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়। তবে অনেক সময় সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে পোল্ডারের ভেতরে নোনা পানি আটকা পড়ে এবং তা জমির লবণাক্ততা বাড়িয়ে দেয়।

পোল্ডারের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মিঠা পানির প্রবাহ বিঘ্নিত হয়, ফলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, পোল্ডারের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় মাটি আরও বেশি লবণাক্ত হয়ে পড়ে।
৬. কৃষি ও মৎস্য খাতের ওপর প্রভাব:
উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ার ফলে কৃষি এবং মৎস্য খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লবণাক্ত মাটি ফসল উৎপাদনের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়ছে এবং নোনা পানি ঢুকে পড়ার ফলে মিঠা পানির মাছের চাষও কঠিন হয়ে উঠছে।

বিশেষ করে ধানের জমিতে লবণাক্ততার কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে, এবং মিঠা পানির মাছ চাষের স্থানে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় চাষাবাদ কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে।
৭. জলজ উদ্ভিদের ক্ষতি:
লবণাক্ততার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের জলজ উদ্ভিদ এবং অন্যান্য জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। নদী, খাল, ও পুকুরের পানিতে নোনা পানি ঢুকে পড়ায় মিঠা পানির উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের জীবনের ওপর প্রভাব পড়ছে। এর ফলে উপকূলীয় এলাকার জীববৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে।

৮. সম্ভাব্য সমাধান এবং কৌশল:
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা সমস্যার সমাধানের জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যেমন:

পোল্ডার ও বাঁধের সঠিক ব্যবস্থাপনা: পোল্ডার এবং বাঁধগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ এবং নোনা পানি নিষ্কাশনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
জলাভূমি সংরক্ষণ: প্রাকৃতিক জলাভূমি এবং বনাঞ্চল সংরক্ষণ করা, যাতে লবণাক্ততার সমস্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের চাষ: লবণাক্ততার প্রতি সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন এবং চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষিকে সহনশীল করা।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: ভারতের সঙ্গে নদীর পানির প্রবাহ নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান খোঁজা।
সারসংক্ষেপ:
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা সমস্যার প্রধান কারণ হলো জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়া, এবং জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়। এই সমস্যাগুলো কৃষি, মৎস্য খাত, এবং জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। সমস্যার সমাধানে সঠিক ব্যবস্থাপনা, টেকসই কৃষি পদ্ধতি, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে

বিভাগসমূহ