নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদান কী?

0

নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদান কী?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
0

অমর্ত্য সেন একজন বিখ্যাত ভারতীয় অর্থনীতিবিদ ও দার্শনিক, যিনি অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে কল্যাণ অর্থনীতি, উন্নয়ন অর্থনীতি, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার কাজ বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য, অসমতা, এবং মানব উন্নয়নের ধারণাকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে। ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পান।

অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদানকে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে:

১. কল্যাণ অর্থনীতিতে অবদান:
অমর্ত্য সেনের সবচেয়ে বড় অবদান হলো কল্যাণ অর্থনীতির (Welfare Economics) ক্ষেত্রে। তিনি কল্যাণ বা সামাজিক মঙ্গল মাপার প্রচলিত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেবলমাত্র আয় বা সম্পদে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা মানুষের ক্ষমতা, সুযোগ, এবং জীবনযাপনের মানের ওপর নির্ভরশীল। তার মতে, উন্নয়ন তখনই পূর্ণতা পায় যখন তা মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে।

তার লেখা বই “Development as Freedom” (উন্নয়ন হিসাবে স্বাধীনতা) এ বিষয়ে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এতে তিনি বলেছেন, উন্নয়নের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের স্বাধীনতা বাড়ানো এবং তাদের জীবনযাপনের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
২. দারিদ্র্য ও ক্ষুধার তত্ত্ব:
অমর্ত্য সেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার বিষয়ে তার তত্ত্ব। তিনি তার বিখ্যাত কাজ “Poverty and Famines” এ দেখিয়েছেন, কীভাবে দুর্ভিক্ষ শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবের কারণে ঘটে না, বরং খাদ্যের বণ্টনের অসমতাও বড় একটি কারণ। তিনি বলেন, দুর্ভিক্ষের সময় অনেক সময় খাদ্য মজুদ থাকে, কিন্তু দরিদ্র মানুষ তাদের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে সেই খাদ্য কিনতে পারে না।

তিনি আরও দেখিয়েছেন, কীভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণগুলোর জন্য দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা সৃষ্টি হয়। তার এই তত্ত্ব দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে নীতি নির্ধারণে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে।
৩. ক্ষমতা ও সক্ষমতা তত্ত্ব (Capability Approach):
অমর্ত্য সেনের আরেকটি প্রধান অবদান হলো ক্ষমতা ও সক্ষমতা তত্ত্ব (Capability Approach)। এই তত্ত্বে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মঙ্গল কেবল আয় বা সম্পদে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের ক্ষমতা বা সক্ষমতা বাড়ানোই আসল উন্নয়ন।

এই তত্ত্বে অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন যে, মানুষের আসল স্বাধীনতা তখনই বাড়ে যখন তারা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে স্বাধীনভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে এবং তাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index – HDI) তৈরি করা হয়, যা জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি শুধু আয় নয়, বরং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়গুলোকে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে।
৪. সামাজিক পছন্দ তত্ত্ব (Social Choice Theory):
অমর্ত্য সেন সামাজিক পছন্দ তত্ত্ব (Social Choice Theory)-এও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এই তত্ত্বটি মূলত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে বিভিন্ন ব্যক্তির পছন্দকে সম্মিলিতভাবে কীভাবে গণ্য করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করে।

অমর্ত্য সেনের কাজ জনকল্যাণ, ন্যায়বিচার, এবং গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে। তার গবেষণা দেখিয়েছে যে, সামাজিক পছন্দ এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা একটি সুস্থ সমাজের জন্য অপরিহার্য।
৫. জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন:
অমর্ত্য সেন নারীর ক্ষমতায়ন এবং জেন্ডার সমতার বিষয়ে কাজ করেছেন। তিনি নারীর প্রতি বৈষম্য, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানের বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তার মতে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি এবং নারীর শিক্ষার প্রসার ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তিনি “Missing Women” নামে একটি তত্ত্বও দিয়েছেন, যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে লিঙ্গবৈষম্যের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নারীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
৬. মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) প্রবর্তন:
অমর্ত্য সেনের ক্ষমতা ও সক্ষমতা তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index – HDI) তৈরি করে। এই সূচকটি কেবলমাত্র আয় নয়, বরং জীবনযাত্রার মান, শিক্ষার হার, এবং স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করে। HDI এখন বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে সহায়ক হয়েছে।

৭. ন্যায়বিচারের তত্ত্ব:
অমর্ত্য সেন ন্যায়বিচারের তত্ত্বেও (Theory of Justice) অবদান রেখেছেন। তার বই “The Idea of Justice” (ন্যায়বিচারের ধারণা) এ তিনি আলোচনা করেছেন, কীভাবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তিনি তাত্ত্বিক ন্যায়বিচারের বাইরে গিয়ে বাস্তব জীবনের ন্যায়বিচারকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং দেখিয়েছেন, সমাজে ব্যক্তির ক্ষমতা, স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচার কীভাবে সমন্বিত হতে পারে।

সারসংক্ষেপ:
অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদান অসামান্য। তার ক্ষমতা ও সক্ষমতা তত্ত্ব, দারিদ্র্য ও ক্ষুধা তত্ত্ব, এবং কল্যাণ অর্থনীতি কেবল অর্থনীতির ক্ষেত্রে নয়, বরং সমাজবিজ্ঞান ও রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। তার তত্ত্ব ও গবেষণা দারিদ্র্য দূরীকরণ, নারীর ক্ষমতায়ন, এবং মানব উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তার চিন্তাভাবনা ও গবেষণা পৃথিবীর বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বিশেষ প্রভাব ফেলেছে এবং বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের ধারণাকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করেছে।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে

বিভাগসমূহ