বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলা ও শিল্প আন্দোলনের বিকাশ কীভাবে হয়েছে?

0

বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলা ও শিল্প আন্দোলনের বিকাশ কীভাবে হয়েছে?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
0

বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলা ও শিল্প আন্দোলনের বিকাশ ধীরে ধীরে, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। দেশজ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে এই আন্দোলন শুরু হয়, যা বর্তমানে বাংলাদেশের শিল্পচর্চার অন্যতম প্রধান দিক হিসেবে পরিগণিত। বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিল্পী এবং প্রতিষ্ঠান এই বিকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন।

নিচে বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলা ও শিল্প আন্দোলনের বিকাশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. ব্রিটিশ আমলে চিত্রকলার প্রভাব:
বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার শুরুর ইতিহাস ব্রিটিশ আমলের সময় থেকে পাওয়া যায়। ব্রিটিশদের সঙ্গে শিল্পকলার নতুন নতুন শৈলী এই অঞ্চলে প্রবেশ করে। কলকাতা আর্ট স্কুল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পশ্চিমা চিত্রকলার ধারাগুলো তৎকালীন পূর্ব বাংলায় প্রসার লাভ করে। এর পাশাপাশি স্থানীয় চিত্রশিল্পীরা এই নতুন শৈলী ও ধারার সঙ্গে নিজেদের ঐতিহ্যকে মিলিয়ে নতুন শিল্পকলা তৈরির চেষ্টা করতে শুরু করেন।

২. শান্তিনিকেতনের প্রভাব:
বাংলাদেশের আধুনিক শিল্প আন্দোলনে শান্তিনিকেতনের একটি বিশাল প্রভাব রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে বাঙালি শিল্পীরা নতুনভাবে শিল্পচর্চা শুরু করেন। শান্তিনিকেতনের শিক্ষাপদ্ধতিতে দেশজ ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল, যা বাংলাদেশের শিল্পীদের মধ্যে প্রভাবিত করে।

বিশেষত, শিল্পী জয়নুল আবেদিন এবং কামরুল হাসান শান্তিনিকেতনের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে তারা বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পচর্চার অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেন।
৩. শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্ব:
বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলার বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। তিনি আধুনিক চিত্রকলার একজন পথিকৃৎ, যিনি চিত্রকলায় আধুনিকতার পাশাপাশি দেশজ ঐতিহ্যকে সন্নিবেশিত করেছেন।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের চিত্রাবলি (Famine Sketches) তার অন্যতম বিখ্যাত কাজ, যেখানে তিনি দুর্ভিক্ষের শিকার মানুষের দুর্দশা ও কষ্টকে গভীরভাবে তুলে ধরেন। এটি শুধু একটি সামাজিক প্রতিচ্ছবি ছিল না, বরং এটি আধুনিক চিত্রকলার এক যুগান্তকারী উদাহরণ।
জয়নুল আবেদিন ১৯৪৮ সালে ঢাকায় ঢাকা আর্ট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলাদেশে চিত্রকলার শিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করে এবং শিল্প আন্দোলনের বিকাশে বিশাল ভূমিকা পালন করে।
৪. কামরুল হাসানের অবদান:
আধুনিক চিত্রকলায় কামরুল হাসান ছিলেন আরেকজন বিশিষ্ট শিল্পী, যিনি জয়নুল আবেদিনের পর বাংলাদেশের শিল্পচর্চার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার কাজগুলোতে বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি অত্যন্ত প্রভাবশালীভাবে ফুটে উঠেছে।

কামরুল হাসানের চিত্রকর্মে গ্রামীণ জীবন, বাঙালির ঐতিহ্য, এবং লোকজ শিল্পের মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধের সময় তার শিল্পকর্ম দেশের মানুষের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
৫. পাকিস্তান আমলে শিল্প আন্দোলন:
বাংলাদেশের আধুনিক চিত্রকলার বিকাশে পাকিস্তান আমল একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পর পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) শিল্পচর্চা আরও সমৃদ্ধ হয়। ঢাকা আর্ট কলেজ এই সময়ে শিল্পচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। শিল্পীরা পাকিস্তানি সংস্কৃতির প্রভাবের বাইরে নিজেদের জাতীয় পরিচয় এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন।

শিল্পীরা স্থানীয় জীবন, বাঙালি সংস্কৃতি, এবং সমাজের নানা দিক নিয়ে কাজ করেন এবং আধুনিক শৈলীতে তাদের প্রতিফলন ঘটান।
৬. মুক্তিযুদ্ধের সময় চিত্রকলার প্রভাব:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের চিত্রকলায় বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। এই সময় শিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংগ্রাম, এবং বেদনাকে তাদের চিত্রকর্মে তুলে ধরেন।

কামরুল হাসান, এস এম সুলতান এবং আরও অনেক শিল্পী মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতীয়তাবাদী চেতনা ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি চিত্রকলার মাধ্যমে তুলে ধরেন। কামরুল হাসানের বিখ্যাত পোস্টার “এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে” মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
৭. স্বাধীনতা-পরবর্তী শিল্পচর্চা ও আধুনিকতা:
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চিত্রকলায় আরও বৈচিত্র্য এবং আধুনিকতা এসেছে। শিল্পীরা আন্তর্জাতিক শিল্পচর্চার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে নতুন নতুন শৈলী এবং মাধ্যমের ব্যবহার শুরু করেন। স্বাধীনতার পর, বাংলাদেশের শিল্পীরা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করতে থাকেন, যা দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ঢাকা আর্ট কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের শিল্পকলা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হতে শুরু করে।
৮. আধুনিক শিল্প আন্দোলনের বিস্তার:
বিভিন্ন শিল্পী এবং শিল্প আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পের বিকাশ ঘটেছে। ১৯৭০-এর দশক থেকে বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী এবং আর্ট মুভমেন্টের উদ্ভব হয়, যা বাংলাদেশে আধুনিক শিল্প আন্দোলনের বিকাশে সহায়ক হয়েছে। বিভিন্ন শিল্প প্রদর্শনী, আর্ট গ্যালারি, এবং আন্তর্জাতিক উৎসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্তর্জাতিক মঞ্চেও স্থান পেয়েছে।

সারসংক্ষেপ:
বাংলাদেশে আধুনিক চিত্রকলার বিকাশ জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান এবং এস এম সুলতানসহ আরও অনেক শিল্পীর অবদানের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। দেশজ ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশ্রণে এই শিল্প আন্দোলন শুরু হয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আরও সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় হয়েছে। ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট, মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব, এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী আন্তর্জাতিক সংযোগ বাংলাদেশের চিত্রকলাকে আরও আধুনিক এবং বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করে তুলেছে।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024

বিভাগসমূহ