এ পি জে আব্দুল কালামের জীবন ও কর্মের মূল দিকগুলো কী?

0

এ পি জে আব্দুল কালামের জীবন ও কর্মের মূল দিকগুলো কী?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
0

ড. এ পি জে আব্দুল কালাম ছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, এবং ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি। তাকে “মিসাইল ম্যান” নামেও অভিহিত করা হয় তার ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণা ও উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য। তার জীবন ও কর্ম বহুমুখী, এবং তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছেন। তার জীবন ও কর্মের কিছু মূল দিক নিচে তুলে ধরা হলো:

১. প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা:
ড. এ পি জে আব্দুল কালাম ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর ভারতের তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে একটি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন নৌকাচালক এবং মা গৃহিনী। কঠিন আর্থিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও তিনি ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় মেধার পরিচয় দেন।

তিনি তিরুচিরাপল্লীর সেন্ট জোসেফস কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর তিনি মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেন।
২. বৈজ্ঞানিক জীবন ও ডিআরডিও:
ড. কালামের বৈজ্ঞানিক জীবন শুরু হয়েছিল ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ডিআরডিও) তে। সেখানে তিনি ভারতের প্রথম স্বদেশী হোভারক্রাফ্ট তৈরি প্রকল্পে কাজ করেন। যদিও প্রকল্পটি সফল হয়নি, তবুও এই কাজ তাকে ভবিষ্যতের অনেক বৃহত্তর প্রকল্পে যুক্ত করে।

৩. ইসরোতে অবদান:
১৯৬৯ সালে তিনি ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ইসরো) তে যোগ দেন। সেখানে তিনি SLV-III (Satellite Launch Vehicle) প্রকল্পে কাজ করেন। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ১৯৮০ সালে ভারত প্রথমবারের মতো “রোহিনী” নামক উপগ্রহকে পৃথিবীর কক্ষপথে সফলভাবে উৎক্ষেপণ করতে সক্ষম হয়। এটি ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এক বড় মাইলফলক ছিল এবং কালামকে একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

৪. মিসাইল ম্যান খ্যাতি:
ড. কালামকে “মিসাইল ম্যান” বলা হয় তার ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য। তিনি “ইন্টিগ্রেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (IGMDP)” এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যার মাধ্যমে “অগ্নি”, “পৃথ্বী”, “ত্রিশূল”, “আকাশ”, এবং “নাগ” ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছিল। এই কর্মসূচির মাধ্যমে ভারত ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তিতে বিশ্বমানের অবস্থানে পৌঁছায়।

৫. পোখরান পরমাণু পরীক্ষায় ভূমিকা:
১৯৯৮ সালে ড. আব্দুল কালাম ভারতের পোখরান-II পরমাণু পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই পরীক্ষার মাধ্যমে ভারত নিজেকে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা করে। কালাম এই পরীক্ষায় বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন এবং তার নেতৃত্বে এই পরীক্ষার সফলতা সম্ভব হয়।

৬. রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন:
২০০২ সালে ড. এ পি জে আব্দুল কালাম ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন জনগণের রাষ্ট্রপতি, যিনি সব সময় সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করেছেন এবং তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তার সময়কালকে একটি শান্তিপূর্ণ এবং অনুপ্রেরণাদায়ক সময় হিসেবে মনে করা হয়।

৭. শিক্ষার প্রতি অনুরাগ:
ড. কালাম শিক্ষাকে সবসময় সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলতেন, “তরুণ প্রজন্মই একটি দেশের ভবিষ্যত।” রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে তিনি বিভিন্ন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং তরুণদের উৎসাহিত করেছেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এতটাই প্রবল ছিল যে তিনি নিজেকে একজন “শিক্ষক” হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন।

৮. লেখক ও দর্শনচিন্তক:
ড. কালাম বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা তার চিন্তা ও দর্শনকে প্রতিফলিত করে। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় বইগুলির মধ্যে রয়েছে:

“Wings of Fire”: এটি তার আত্মজীবনী যেখানে তিনি তার জীবনের সংগ্রাম এবং সাফল্যের কথা বর্ণনা করেছেন।
“Ignited Minds”: এই বইয়ে তিনি ভারতের তরুণ প্রজন্মকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতির মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
“India 2020”: এই বইতে তিনি ভারতের ভবিষ্যত উন্নয়নের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন, যেখানে তিনি ভারতকে ২০২০ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।
৯. মূল্যবোধ ও দর্শন:
কালামের জীবন ও কর্ম মূলত সহজ জীবনযাপন এবং মহান চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে। তিনি সব সময় মানুষকে নৈতিক মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলতেন, “যত বড় স্বপ্ন দেখবে, তত বড় সাফল্য পাবে।” তিনি কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, এবং নৈতিকতার মধ্যে মানুষের জীবনের প্রকৃত সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিলেন।

১০. জনগণের রাষ্ট্রপতি:
রাষ্ট্রপতি হিসেবে ড. কালাম সাধারণ মানুষের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে কাজ করতেন এবং সবসময় তাদের সমস্যার কথা শুনতেন। তিনি কখনোই রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের মর্যাদাকে বড় করে দেখেননি, বরং একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে কাজ করেছেন।

১১. নেতৃত্ব ও অনুপ্রেরণা:
ড. কালাম সবসময় একজন নেতা ও অনুপ্রেরণাদাতা ছিলেন। তার নেতৃত্বে ভারত বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। তার ব্যক্তিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বিনয়, সততা, এবং সবার সঙ্গে সমানভাবে আচরণ করা।

১২. বিশ্বের প্রতি দায়বদ্ধতা:
ড. কালাম কেবল ভারতের জন্যই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর জন্যও শান্তি এবং উন্নয়নের বার্তা বহন করেছেন। তিনি সবসময় বৈশ্বিক শান্তি ও মানবতার পক্ষে কথা বলেছেন এবং বিশ্বকে একটি সমৃদ্ধ, নিরাপদ এবং শান্তিপূর্ণ স্থানে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

১৩. বিপ্লবী চিন্তা ও উন্নয়ন:
তার ভাবনা ও কাজের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতকে একটি শক্তিশালী এবং আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি সব সময় বলতেন, “উন্নতির জন্য শক্তি এবং সাহস প্রয়োজন।” তিনি বিশেষভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতির মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

১৪. মৃত্যু ও উত্তরাধিকার:
ড. এ পি জে আব্দুল কালাম ২০১৫ সালের ২৭ জুলাই ভারতের শিলংয়ে একটি বক্তৃতা দেওয়ার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু ভারতের জন্য একটি বড় ক্ষতি ছিল, তবে তার আদর্শ এবং শিক্ষা আজও ভারতের জনগণকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

১৫. তরুণ প্রজন্মের প্রতি অঙ্গীকার:
কালাম সব সময় তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিত, সচেতন এবং উদ্ভাবনী হতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, “তরুণরাই দেশের ভবিষ্যত, এবং তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রতিটি প্রজন্মের কর্তব্য।” তার প্রতিটি বক্তৃতায় তরুণদের জন্য একটি বিশেষ বার্তা থাকত, যা তাদের জীবনকে গঠনমূলক এবং সৃষ্টিশীল পথে পরিচালিত করত।

সারসংক্ষেপ:
ড. এ পি জে আব্দুল কালাম ছিলেন একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব, যার জীবন ও কর্ম অসংখ্য মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা। তার বৈজ্ঞানিক অবদান, শিক্ষা ও নেতৃত্বে ভারত একটি শক্তিশালী এবং আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে উঠেছে। তার চিন্তা ও আদর্শ আজও ভারতে এবং বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যে উদ্ভাবনী এবং গঠনমূলক মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করছে।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে

বিভাগসমূহ