বাংলা শব্দতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্বের মূল বিষয় কী?

0

বাংলা শব্দতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্বের মূল বিষয় কী?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 11, 2024
0

বাংলা শব্দতত্ত্ব এবং ধ্বনিতত্ত্ব বাংলা ভাষার ভাষাবিজ্ঞানীয় দিকগুলোর দুটি প্রধান শাখা, যা ভাষার গঠন এবং ব্যবহার নিয়ে বিশদ গবেষণা করে। বাংলা ভাষায় শব্দ ও ধ্বনির গঠন, উৎপত্তি, অর্থ এবং প্রয়োগের বিষয়গুলো শব্দতত্ত্ব ও ধ্বনিতত্ত্বে বিশ্লেষণ করা হয়। এই দুটি শাখার মূল বিষয়গুলি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:

১. বাংলা শব্দতত্ত্ব (Lexicology)

শব্দতত্ত্ব হলো ভাষার শব্দভাণ্ডার, শব্দের গঠন, উৎপত্তি, এবং তাদের অর্থ নিয়ে আলোচনা করে। বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব মূলত এই বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করে গঠিত:

ক. শব্দের উৎপত্তি এবং শ্রেণীবিভাগ
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দগুলো বিভিন্ন উৎস থেকে এসেছে, যেমন:

তৎসম: সংস্কৃত থেকে সরাসরি গৃহীত শব্দ, যেমন: অগ্নি, সূর্য, মাতা।
তদ্ভব: সংস্কৃত থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় ব্যবহৃত শব্দ, যেমন: অগি → আগুন, সূর্য → সুর্য।
দেশি: বাংলা ভাষার নিজস্ব উৎপত্তি বা দেশজ শব্দ, যেমন: পাখি, মাটি।
বিদেশি: অন্যান্য ভাষা থেকে গৃহীত শব্দ, যেমন: চেয়ার (ইংরেজি), মিছরি (ফার্সি)।
খ. শব্দগঠন (Word Formation)
বাংলা ভাষায় শব্দগঠন প্রক্রিয়াটি মূলত উপসর্গ, প্রত্যয় এবং সমাসের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। শব্দগঠন প্রক্রিয়ার প্রধান দিকগুলো হলো:

উপসর্গ: শব্দের আগে যোগ করে নতুন অর্থ সৃষ্টির প্রক্রিয়া, যেমন: অ- (অবধি, অসাধারণ)।
প্রত্যয়: শব্দের শেষে যোগ করে নতুন অর্থ সৃষ্টি, যেমন: -তা (সুন্দর + তা = সুন্দরতা)।
সমাস: দুই বা ততোধিক শব্দের মিলনে নতুন শব্দগঠন, যেমন: রাম + লক্ষণ = রামলক্ষণ।
গ. শব্দার্থ (Semantics)
শব্দতত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শব্দের অর্থ এবং তার পরিবর্তন। এটি মূলত শব্দের বহুমুখী অর্থ এবং প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করে। উদাহরণ:

অর্থের বিবর্তন: অনেক শব্দের অর্থ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে, যেমন “গুরু” শব্দটি প্রাচীনকালে শুধুমাত্র শিক্ষক বোঝাতে ব্যবহার হতো, কিন্তু এখন এর অর্থ অনেক বিস্তৃত।
ঘ. শব্দের প্রয়োগ (Usage)
শব্দের প্রয়োগ এবং বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তার ব্যবহারের ধরন শব্দতত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। বাংলা ভাষায় শব্দের অর্থ এবং ব্যবহার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাসঙ্গিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে।

২. বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology)

ধ্বনিতত্ত্ব হলো ভাষার ধ্বনি, তাদের উচ্চারণ, সংস্থান, এবং পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করে। বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্ব মূলত ধ্বনি, তাদের শ্রেণিবিন্যাস এবং ব্যাকরণের সঙ্গে সম্পর্কিত ধ্বনিগত প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করে।

ক. ধ্বনির শ্রেণীবিন্যাস (Classification of Sounds)
বাংলা ভাষায় ধ্বনিগুলো প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত:

স্বরধ্বনি (Vowels): বাংলা ভাষায় ১১টি স্বরধ্বনি রয়েছে। যেমন: অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, এ, ঐ, ও, ঔ।
ব্যঞ্জনধ্বনি (Consonants): বাংলা ভাষায় ৩৯টি ব্যঞ্জনধ্বনি রয়েছে। যেমন: ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ ইত্যাদি।
খ. ধ্বনির স্থান ও পদ্ধতি (Place and Manner of Articulation)
ধ্বনিগুলো বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়, এবং তাদের উচ্চারণের স্থান ও পদ্ধতি বিশ্লেষণ করা হয়:

স্থানভিত্তিক শ্রেণীকরণ: ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ কোথা থেকে উৎপন্ন হয়, তা অনুযায়ী তাদের ভাগ করা হয়। যেমন:
মুখ্যধ্বনি (Labials): প, ফ, ব, ম।
দন্ত্যধ্বনি (Dentals): ত, থ, দ, ন।
কণ্ঠ্যধ্বনি (Velars): ক, খ, গ।
পদ্ধতিভিত্তিক শ্রেণীকরণ: ধ্বনির উচ্চারণ কিভাবে হয় তা অনুসারে তাদের ভাগ করা হয়। যেমন:
অন্তস্থ (Nasal): ম, ন, ণ।
স্পর্শধ্বনি (Plosives): ক, গ, প, ব।
গ. ধ্বনি পরিবর্তন (Phonological Changes)
বাংলা ভাষায় ধ্বনির পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা সময়ের সাথে সাথে ভাষার বিকাশে ঘটে থাকে। এই ধ্বনির পরিবর্তনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রক্রিয়া হলো:

মহাপ্রাণ ধ্বনির লোপ: বাংলা ভাষায় অনেক সময় মহাপ্রাণ ধ্বনি লোপ পায়। যেমন, “ঘটনা” শব্দের উচ্চারণে প্রথম “ঘ” ধ্বনি অনেক সময় অব্যক্ত থাকে।
ধ্বনির রূপান্তর: অনেক সময় ধ্বনি একে অপরের প্রভাবে পরিবর্তিত হয়। যেমন, “কৃপণ” → “কিপ্টে”।
ঘ. সংযোজন ও বিয়োজন (Phonotactics)
বাংলা ভাষায় ধ্বনিগুলোর সমন্বয় এবং ধ্বনি থেকে ধ্বনির অবস্থানগত পরিবর্তন ধ্বনিতত্ত্বে আলোচনা করা হয়। ধ্বনি কীভাবে সংযোজিত বা বিয়োজিত হয়, তা ব্যাকরণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

ঙ. স্বরাঘাত (Stress) এবং স্বরক্ষেপ (Intonation)
বাংলা ভাষায় স্বরাঘাত এবং স্বরক্ষেপ ধ্বনির তাৎপর্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে:

স্বরাঘাত: কোন শব্দের কোন অংশে জোর বা চাপ দেওয়া হয়, তা বাক্যের অর্থ পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন, “কলাম” এবং “কলা” শব্দে ভিন্ন ভিন্ন স্বরাঘাত।
স্বরক্ষেপ: বাক্যের ভিন্ন ভিন্ন টোন বা স্বরের ওঠানামা বাক্যের অর্থ এবং বক্তব্যকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে পারে।
উপসংহার
বাংলা ভাষার শব্দতত্ত্ব এবং ধ্বনিতত্ত্ব ভাষার গঠন এবং বিকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি শাখা। শব্দতত্ত্বে শব্দের উৎপত্তি, গঠন, এবং অর্থ নিয়ে কাজ করা হয়, যেখানে ধ্বনিতত্ত্ব ভাষার ধ্বনি এবং তাদের উচ্চারণ ও প্রয়োগ নিয়ে বিশ্লেষণ করে। বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার এবং ধ্বনিগত প্রকৃতি এই দুটি শাখার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়, যা ভাষার সঠিক ব্যবহারের জন্য অপরিহার্য।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 11, 2024

বিভাগসমূহ