অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদান কী?
অমর্ত্য সেন একজন বিশ্ববিখ্যাত ভারতীয় অর্থনীতিবিদ এবং দার্শনিক, যিনি অর্থনীতি এবং সমাজবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার কাজগুলি অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, দারিদ্র্য, উন্নয়ন এবং কল্যাণ অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি ১৯৯৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নিচে অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদানের প্রধান দিকগুলো আলোচনা করা হলো:
১. কল্যাণ অর্থনীতি (Welfare Economics)
অমর্ত্য সেন কল্যাণ অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রেখেছেন। তিনি মানুষের ক্ষমতাবৃদ্ধি এবং ক্ষমতাসম্পন্নতা (Capability Approach) তত্ত্বের প্রবক্তা, যা কল্যাণ মাপার জন্য একটি নতুন ধারণা উপস্থাপন করে। তিনি মনে করেন, কল্যাণের মাত্রা শুধু আয়ের ওপর নির্ভর করে না, বরং মানুষের বাস্তব ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, অর্থাৎ কীভাবে একজন ব্যক্তি নিজের জীবন যাপনের ক্ষমতা অর্জন করছে।
ক্ষমতাসম্পন্নতা তত্ত্ব (Capability Approach): এই তত্ত্বের মূল ধারণা হলো, একটি সমাজের উন্নতি বা কল্যাণ কেবলমাত্র আয় বা সম্পদের পরিমাপ নয়, বরং মানুষ কী করতে সক্ষম এবং তাদের বেঁচে থাকার মান কি, তা দেখে মাপা উচিত। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি পর্যাপ্ত আয় পেলেও যদি সে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বা জীবনের অন্যান্য মৌলিক সুবিধা না পায়, তাহলে সেই আয় অর্থহীন।
২. দারিদ্র্য এবং অসমতার পরিমাপ
অমর্ত্য সেন দারিদ্র্য এবং অসমতা নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেছেন। তিনি শুধু আয় নির্ভর দারিদ্র্য পরিমাপকে অস্বীকার করে আরও বিস্তৃত একটি পরিমাপ ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যা মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং সুযোগের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে।
সেন সূচক (Sen Index): দারিদ্র্যের পরিমাপের জন্য তিনি একটি সূচক তৈরি করেছেন যা শুধু মাথাপিছু আয় দেখে না, বরং দারিদ্র্যের গভীরতা এবং অসাম্যকেও বিবেচনায় নেয়। এই সূচকটি পরে দারিদ্র্য পরিমাপের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য হয়।
৩. মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index)
অমর্ত্য সেনের তত্ত্ব এবং কাজগুলি জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সূচকটি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP) দ্বারা ব্যবহৃত হয়, যা বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিমাপ করে। HDI মূলত তিনটি বিষয়ে ফোকাস করে: আয়, শিক্ষা, এবং জীবনযাপনের মান (স্বাস্থ্য)।
মানব উন্নয়নের ধারণা: সেনের কাজগুলো মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তাধারা জন্ম দিয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন যে উন্নয়নের প্রকৃত মানে কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানুষের জীবনযাপনের মানের উন্নতি।
৪. দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্য অধিকার (Famine and Food Entitlement)
অমর্ত্য সেনের গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্য অধিকার নিয়ে তাঁর কাজ। তাঁর তত্ত্বে বলা হয়েছে যে দুর্ভিক্ষ শুধু খাদ্য উত্পাদনের ঘাটতির কারণে হয় না, বরং তা সঠিক বণ্টনের অভাব এবং মানুষের খাদ্য অধিকার না থাকার জন্য ঘটে।
Entitlement Theory (অধিকার তত্ত্ব): এই তত্ত্ব অনুযায়ী, দুর্ভিক্ষ তখন ঘটে যখন মানুষের খাদ্য অধিকার বা “entitlement” ভেঙে পড়ে, অর্থাৎ যখন মানুষের খাদ্য কেনার বা সংগ্রহের সক্ষমতা থাকে না। খাদ্য উৎপাদন থাকলেও যদি মানুষের কাছে তা পৌঁছানো না যায়, তবে দুর্ভিক্ষ হতে পারে।
৫. গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন (Democracy and Development)
অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দাবি করেছেন যে গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা কম, কারণ গণতন্ত্রে সরকার জনগণের চাহিদার প্রতি বেশি সংবেদনশীল থাকে।
গণতন্ত্রের ভূমিকা: সেনের মতে, একটি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র একটি অপরিহার্য শর্ত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৬. লিঙ্গ বৈষম্য এবং নারীর অধিকার
অমর্ত্য সেন লিঙ্গ বৈষম্যের ওপর ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য নারীদের অধিকার এবং ক্ষমতায়ন কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর গবেষণায় নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং তাদের শিক্ষার সুযোগকে উন্নয়নের একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
Missing Women Problem: অমর্ত্য সেন “Missing Women” সমস্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন, যা এমন নারীদের সংখ্যা নির্দেশ করে, যারা আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের কারণে তাদের জীবন হারায় বা গর্ভপাতের শিকার হয়। এই গবেষণা লিঙ্গ বৈষম্যের প্রভাব বুঝতে সাহায্য করে।
৭. নৈতিক এবং রাজনৈতিক দর্শন
অমর্ত্য সেন অর্থনীতি এবং নৈতিকতার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনীতির সাথে সামাজিক এবং নৈতিক দায়িত্বকে যুক্ত করে, যা ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা, এবং মানুষের অধিকারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।
অর্থনৈতিক নৈতিকতা: তিনি দেখিয়েছেন যে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে কেবলমাত্র মুনাফার জন্য নয়, বরং নৈতিক ন্যায়বিচারের জন্যও নেওয়া উচিত।
উপসংহার:
অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে অবদান শুধুমাত্র অর্থনৈতিক তত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি সমাজ, নৈতিকতা, এবং রাজনীতির সাথেও অর্থনীতিকে যুক্ত করেছেন। তার ক্ষমতাসম্পন্নতা তত্ত্ব, দারিদ্র্য এবং অসমতার পরিমাপ, মানব উন্নয়ন সূচক, খাদ্য অধিকার তত্ত্ব, এবং গণতন্ত্র ও উন্নয়ন সংক্রান্ত গবেষণা আজও বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পথনির্দেশক। তাঁর কাজগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে এবং ভবিষ্যতেও বিশ্বব্যাপী সমাজ ও অর্থনীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে।