তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসের বিতর্কিত দিকগুলো কী?

0

তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসের বিতর্কিত দিকগুলো কী?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 7 দিন পূর্বে
0

তসলিমা নাসরিন বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখিকা এবং মানবাধিকার কর্মী, যিনি তার সাহিত্যে সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং বাঙালি নারীর অবস্থান তুলে ধরেন। তার উপন্যাস ‘লজ্জা’ (শরীরচর্চা) ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় এবং এটি বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য বিতর্ক সৃষ্টি করে। নিচে ‘লজ্জা’ উপন্যাসের প্রধান বিতর্কিত দিকগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

১. ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিবরণ
হিন্দু সম্প্রদায়ের অভাব: ‘লজ্জা’ উপন্যাসে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্দশা এবং শোষণকে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের বিরুদ্ধে একটি সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, যা অনেক মুসলিম পাঠকের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
উল্টো-পাতা: উপন্যাসটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থা তুলে ধরে, যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিকে সমালোচনা করে। অনেক পাঠক মনে করেন যে, এটি একটি পক্ষপাতদুষ্ট এবং একঘেয়ে চিত্রাঙ্কন।
২. অভিযোজন ও প্রভাব
বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা: ‘লজ্জা’ বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয়, এবং বইয়ের প্রচারকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং ধর্মীয় সংহতি সম্পর্কে একটি বিকৃত ধারণা তৈরি করেছে।
সামাজিক উত্তেজনা: বইয়ের প্রকাশের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে, যা সমাজে দ্বন্দ্ব এবং বিভাজন সৃষ্টি করে।
৩. লেখিকার প্রতি হিংসা ও হুমকি
প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া: ‘লজ্জা’ প্রকাশের পর তসলিমা নাসরিনকে ব্যাপকভাবে প্রতিকূলতা ও হুমকি জড়ানো হয়। ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের তরফ থেকে তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালানো হয় এবং তাকে দেশে থেকে নির্বাসিত করার দাবি ওঠে।
পদার্থিক ও মানসিক নির্যাতন: তার পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের ওপর হামলা করা হয় এবং নিজে নিজে তার উপর প্রচুর মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। এর ফলে, তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভারত ও পশ্চিমা দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
৪. স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের প্রশ্ন
স্বাধীন মতপ্রকাশের সীমা: ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের পরে ধর্মীয় সংহতি এবং জাতীয় ঐক্যের ওপর প্রশ্ন তোলে। এটি স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং সাহিত্যিক স্বাধীনতার সীমা নিয়ে একটি বৃহত্তর বিতর্ক সৃষ্টি করে।
নৈতিক ও নৈতিকতা সংক্রান্ত প্রশ্ন: উপন্যাসটি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা বাংলাদেশে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের আলোকে বিতর্কিত হয়।
৫. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সাহিত্যের স্বাধীনতা: পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘লজ্জা’ এর সমর্থন পাওয়া যায় এবং তসলিমা নাসরিনকে সাহিত্যিক স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এই সমর্থন বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন উত্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন: ‘লজ্জা’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে আলোচনার বিষয় তৈরি করে।
৬. সাহিত্যিক ও নৈতিক সমালোচনা
পক্ষপাতদুষ্টতা: অনেক সমালোচক মনে করেন যে ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি পক্ষপাতদুষ্ট এবং একধাপের। তারা বলেন যে, উপন্যাসটি সমগ্র মুসলিম সম্প্রদায়কে একধরনের চিত্রে চিত্রিত করে যা বাস্তবতার সাথে মেলে না।
সাহিত্যিক মান: কিছু সাহিত্যিক সমালোচনা করেন যে, উপন্যাসটির ভাষা ও কাঠামো তসলিমার সাধারণ পাঠকদের জন্য উপযুক্ত নয় এবং এটি ত্রুটিযুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
৭. সামাজিক পরিবর্তন ও পুনর্গঠন
সামাজিক সচেতনতা: ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি সমাজে ধর্মীয় সংহতি ও সহিষ্ণুতার গুরুত্ব তুলে ধরে, যা সামাজিক পরিবর্তন এবং পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে।
মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার: উপন্যাসটি মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের প্রতি গুরুত্ব দেয়, যা সমাজে এই বিষয়গুলির প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা সৃষ্টি করে।
উপসংহার
তসলিমা নাসরিনের ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি বাংলাদেশের সাহিত্য ও সমাজে এক গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে ধর্মীয় সংহতি, সামাজিক ন্যায়বিচার, এবং মানবাধিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে। তবে, এর পক্ষপাতদুষ্ট এবং বিতর্কিত চিত্রাঙ্কনের কারণে এটি ব্যাপক সমালোচনা এবং হিংসার মুখে পড়েছে। ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি সাহিত্যিক স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের সীমা নিয়ে এক বৃহত্তর বিতর্কের সূচনা করেছে, যা আজও বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হিসেবে বিদ্যমান।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 7 দিন পূর্বে

বিভাগসমূহ