ভারতের কাশ্মীর সমস্যার ইতিহাস কী?

21 বার দেখারাজনীতিইতিহাস কাশ্মীর ভারত
0

ভারতের কাশ্মীর সমস্যার ইতিহাস কী?

রুদ্রনীল দাশগুপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 7 দিন পূর্বে
0

কাশ্মীর সমস্যা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল ভূরাজনৈতিক বিরোধগুলির মধ্যে একটি। ভারত, পাকিস্তান এবং চীনের মধ্যে এই তিন দেশের মধ্যে কাশ্মীরের ওপর বিরোধ রয়েছে, যা সময়ের সাথে সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় গভীর প্রভাব ফেলেছে। কাশ্মীরের ইতিহাস এবং সমস্যার গভীরতা বুঝতে হলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা এবং বিভাজনের প্রেক্ষাপট গুরুত্বপূর্ণ।

১. ব্রিটিশ ভারতে বিভাজন এবং কাশ্মীরের পরিস্থিতি (১৯৪৭)
ক. ব্রিটিশ ভারতের বিভাজন

১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা লাভ করে এবং দেশটি ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়।
বিভাজনের সময় ধর্মীয় ভিত্তিতে ভাগ হয়, যেখানে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো পাকিস্তানে চলে যায় এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো ভারতে।
খ. কাশ্মীরের ভূগোল এবং ধর্ম

কাশ্মীর মূলত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হলেও, রাজা হরি সিনহ একটি হিন্দু রাজবংশের অধীনে ছিলেন।
রাজা হরি সিনহ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কাশ্মীর রাখার সিদ্ধান্ত নেন, কিন্তু পাকিস্তানের চাপ এবং আক্রমণবিদ্ধ হওয়ায় তিনি ভারতকে যোগ দিতে বাধ্য হন।
২. অ্যাক্সেসমেন্ট এবং প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭-৪৮)
ক. অ্যাক্সেসমেন্টের সূত্রপাত

রাজা হরি সিনহ কাশ্মীরের একটি অংশ ভারতীয় ব্রিটিশ রাজ্যে যোগ দিতে রাজি হন।
১৯৪৭ সালের অক্টোবরে, হরি সিনহ ভারত সরকারের সাথে অ্যাক্সেসমেন্টের চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা কাশ্মীরকে ভারতে যোগদানের অনুমতি দেয়।
খ. পাকিস্তানের আক্রমণ

অ্যাক্সেসমেন্টের পর, পাকিস্তান কাশ্মীরের ওপর আক্রমণ চালায়।
প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৪৭-৪৮) সংঘটিত হয়, যা শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৪৮ সালে বন্ধ হয়।
গ. জাতিসংঘের ভূমিকা

জাতিসংঘ একটি জরুরি মিশন প্রেরণ করে এবং কাশ্মীরের জন্য একটি শান্তি রক্ষী বাহিনী স্থাপন করে।
১৯৪৯ সালে, লাইন অফ কন্ট্রোল (LoC) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ভারতের এবং পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীরের বিভাজন চিহ্নিত করে।
৩. পরবর্তী যুদ্ধ এবং সীমান্ত সংঘর্ষ
ক. দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৬৫)

১৯৬৫ সালে দ্বিতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা কাশ্মীরের কারণে হয়।
যুদ্ধ শেষ হয় জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় এবং চুক্তির মাধ্যমে সীমান্ত পুনরায় নির্ধারণ করা হয়।
খ. তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ (১৯৭১)

১৯৭১ সালে তৃতীয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) কেন্দ্রীভূত ছিল।
যুদ্ধের পর, বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং কাশ্মীরের বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পুনরায় জটিল হয়ে ওঠে।
গ. কর্গিল যুদ্ধ (১৯৯৯)

১৯৯৯ সালে কর্গিল যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যা মূলত কাশ্মীরের লাঙ্গটাঙ্গা অঞ্চলে হয়।
এই যুদ্ধের ফলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা তীব্র হয়, যদিও লাঙ্গটাঙ্গা যুদ্ধ ভারতীয় বিজয়ী হয়।
৪. ভারতের কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ সংঘাত
ক. মিলে গৃহযুদ্ধের শুরু (১৯৮৯)

১৯৮৯ সালে কাশ্মীরের মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়, যা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক ও অস্ত্রধারী দলগুলির আক্রমণের মাধ্যমে চিহ্নিত হয়।
এই বিদ্রোহের প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক অসন্তোষ, অর্থনৈতিক অবনতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন।
খ. নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতিক্রিয়া

ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও পুলিশ বিদ্রোহমুক্তির জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়।
এই সময়ে অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার ঘটনা ঘটে, যা আন্তর্জাতিক সমালোচনার বিষয় হয়।
৫. আধুনিক সময়ের কাশ্মীর সমস্যা
ক. অ্যাক্ট অফ হাইজেন ও আর্টিকেল ৩৭০ (১৯৯৯)

ভারত কাশ্মীরের স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে রাখার জন্য সংবিধানের আর্টিকেল ৩৭০ রদবদল করে।
২০১৯ সালে, ভারত সরকার আর্টিকেল ৩৭০ সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে, যা কাশ্মীরকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নিয়ে আসে। এটি আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়ে এবং পাকিস্তানের সাথে উত্তেজনা বাড়ায়।
খ. বর্তমান সামরিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা

কাশ্মীর অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়ছে, এবং সীমানা অঞ্চলে নিয়মিত সংঘর্ষের খবর আসে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাশ্মীরের স্থিতি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র বিতর্ক রয়েছে।
৬. আন্তর্জাতিক প্রভাব ও ভূমিকা
ক. জাতিসংঘের ভূমিকা

জাতিসংঘ কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে একাধিক প্রচেষ্টা করেছে, তবে নির্দিষ্ট সমাধানে অক্ষম হয়েছে।
LoC একটি স্থায়ী সমাধান নয় এবং এটি কাশ্মীরের শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে না।
খ. অন্যান্য বড় শক্তির ভূমিকা

চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কাশ্মীর সমস্যার জটিলতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
চীন কাশ্মীরের কিছু অংশে দাবি করে এবং উন্নয়ন প্রকল্পে সক্রিয়, যা ভারতকে চ্যালেঞ্জ করে।
উপসংহার
কাশ্মীর সমস্যা ভারতের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে থেকে যাচ্ছে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এই সমস্যার নানা দিক থেকে সমাধানের প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তবে এখনও একটি স্থায়ী সমাধান পাওয়া যায়নি। ভারতের ও পাকিস্তানের মধ্যে কাশ্মীরের ওপর দ্বন্দ্ব কেবল এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় গভীর প্রভাব ফেলে। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে এগিয়ে যেতে হলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বিশ্বাসের ভিত্তিতে আলোচনার উদ্যোগ এবং কাশ্মীরের জনগণের শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা অপরিহার্য।

নোট: কাশ্মীর সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। সর্বশেষ তথ্য এবং ঘটনা জানার জন্য বিশ্বস্ত সংবাদ মাধ্যম এবং সরকারি সূত্রের উপর নির্ভর করা উচিত।

রুদ্রনীল দাশগুপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 7 দিন পূর্বে

বিভাগসমূহ