রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছিলেন?

648 বার দেখাইতিহাসবাঙালি ভারত
0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে ছিলেন?

রুদ্রনীল দাশগুপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 5, 2024
0

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি কবি, নাট্যকার, উপন্যাসিক, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, দার্শনিক, এবং শিক্ষাবিদ। তিনি বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম প্রতিভা এবং বিশ্ব সাহিত্যের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে “গীতাঞ্জলি” নামক কবিতা সংগ্রহের জন্য ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, যা তাঁকে প্রথম অ-ইউরোপীয় নোবেল বিজয়ী করে তোলে।

জীবনচরিত

জন্ম এবং পারিবারিক পটভূমি:
জন্ম: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ মে ১৮৬১ সালে কলকাতার গৌড়পুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম দীনানন্দ ঠাকুর এবং মাতার নাম সোনালী মাতা।
পরিবার: ঠাকুর পরিবার বাঙালি সমাজের এক প্রভাবশালী এবং শিক্ষিত পরিবার ছিল। তাঁর চাচা সুকুমার ঠাকুর ছিলেন একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং নাট্যকার, যাঁর প্রভাব তাঁকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল।
শিক্ষা:
রবীন্দ্রনাথ প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন কলকাতার নিজ শহরে। তিনি ১৮৭৮ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান, কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে ১৮৮০ সালে ফিরে আসেন।
তার পরে তিনি কলকাতায় ফিরে এসে রোহিঙ্গা স্কুল এবং হাইস্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যান, যদিও তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে উচ্চশিক্ষা লাভ করেননি।
ব্যক্তিগত জীবন:
রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিবাহ মালতি দেবী এর সাথে হয়, কিন্তু কিছু সময় পরে তারা বিচ্ছেদ লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি রমা দেবী এর সাথে বিবাহিত হন এবং তাঁদের চার সন্তান জন্মগ্রহণ করেন।
সাহিত্যিক অবদান

কবিতা:
গীতাঞ্জলি: রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা সংগ্রহ তাঁর নোবেল পুরস্কারের প্রধান কারণ। এটি মনের গভীরতা, আধ্যাত্মিকতা, এবং মানবতার মর্মস্পর্শী অনুভূতি প্রকাশ করে।
জনগনমন: এই গানটি ভারতের জাতীয় সংগীত এবং বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত: তাঁর রচিত প্রায় ২২০০টি গান, যা বাঙালি সঙ্গীতের অমর নিদর্শন, বিভিন্ন আবেগ ও মনের অবস্থা ফুটিয়ে তোলে।
নাটক এবং উপন্যাস:
চোখের বালি: একটি বিখ্যাত বাংলা উপন্যাস, যা ত্রৈমাসিক নাটকে রূপান্তরিত হয়েছে।
ঘরে বাইরে: সমাজের বিভিন্ন দিককে নিয়ে রচিত নাটক।
রক্তকরবী: বাঙালি সমাজের সামাজিক অসঙ্গতি তুলে ধরেছে এই উপন্যাসে।
ছোট গল্প:
রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পগুলি মানবীয় সম্পর্ক, নৈতিকতা, এবং সমাজের নানা দিককে স্পর্শ করে। “অপুর গল্প” সিরিজটি তার জনপ্রিয় ছোট গল্পগুলোর মধ্যে একটি।
চিত্রশিল্প:
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন প্রতিভাধর চিত্রশিল্পীও। তাঁর আঁকা ছবি এবং আঁকাগুলিতে প্রকৃতি ও মানবীয় অনুভূতির সূক্ষ্ম প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
গবেষণা ও দার্শনিকতা:
তিনি মানব জীবনের অর্থ, ধর্ম, নৈতিকতা, এবং শিক্ষার উপর গভীর চিন্তাভাবনা করেছেন। তাঁর লেখা “দীপাবলি” এবং “জাতি সংগ্রাম” দার্শনিক চিন্তার উদাহরণ।
শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠা

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়:
১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, যা গৌড়পুরে অবস্থিত। এটি একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত, যেখানে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থী ও শিক্ষাবিদরা একত্রিত হয়।
শিক্ষা দর্শন:
তাঁর শিক্ষা দর্শন ছিল মুক্ত শিক্ষা, যেখানে ব্যক্তিগত বিকাশ এবং সৃজনশীলতার ওপর জোর দেওয়া হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের মনকে মুক্ত করা যায়।
সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব

বাঙালি জাতীয়তাবাদ:
রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর লেখা এবং ভাষণগুলি বাঙালি জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনা জাগ্রত করে।
স্বাধীনতা সংগ্রাম:
তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন প্রদান করেন এবং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন।
ধর্মীয় সহাবস্থান:
রবীন্দ্রনাথ ধর্মীয় সহাবস্থান এবং আন্তঃধর্মীয় মৈত্রী প্রচার করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সাথে মেলামেশা করতেন এবং ধর্মীয় সংহতির বার্তা প্রদান করতেন।
পুরস্কার ও সম্মান

নোবেল পুরস্কার:
১৯১৩ সালে তিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন, যা বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম ও একমাত্র কাজ গীতাঞ্জলি এর জন্য। এটি তাকে প্রথম অ-ইউরোপীয় নোবেল বিজয়ী করে তোলে।
বাংলা সাহিত্যে অবদান:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণকারীরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম বাংলা ভাষাকে বৈচিত্র্যময় এবং সমৃদ্ধ করেছে।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মান:
তিনি ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে সম্মানিত। বিভিন্ন স্মৃতিস্তম্ভ, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে তাঁর নামকরণ করা হয়েছে।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার

মৃত্যু:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৭ আগস্ট ১৯৪১ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর সাহিত্যকর্ম ও চিন্তাধারা যুগে যুগে প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
উত্তরাধিকার:
তাঁর লেখা, গান, নাটক, ও চিত্রকলাগুলি আজও বাঙালি এবং বিশ্ব সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গীতাঞ্জলি, জনগনমন, চোখের বালি, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত সহ তাঁর বিভিন্ন কাজ বাংলা সাহিত্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
স্মৃতি ও উদযাপন:
রবীন্দ্র দিবস (২৫ মে) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উদযাপিত হয়, যেখানে তাঁর জীবন ও কাজকে স্মরণ করা হয়।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলিতে তাঁর স্মৃতি রক্ষা ও উদযাপন করা হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রদর্শনী, এবং সাহিত্যিক কর্মসূচির মাধ্যমে।
উপসংহার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একজন মহান সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী, এবং দার্শনিক, যিনি বাংলা সাহিত্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম শুধু বাংলা ভাষায় নয়, বরং বিশ্ব সাহিত্যতে এক অনন্য স্থান অধিকার করে। তাঁর নোবেল পুরস্কার, গীতাঞ্জলি, এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতের মতো কাজগুলি আজও মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করছে এবং মানবতার নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার উৎস হিসেবে রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কাজ বাংলা সংস্কৃতির জন্য এক অমূল্য ধন, যা ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে রয়ে যাবে।

রুদ্রনীল দাশগুপ্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 5, 2024

বিভাগসমূহ