বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন কেন এবং কীভাবে সংঘটিত হয়?

109 বার দেখাইতিহাসবঙ্গভঙ্গ
0

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন কেন এবং কীভাবে সংঘটিত হয়?

আহমেদ রুসেল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024
0

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক আন্দোলন। এটি মূলত ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের ফলস্বরূপ সংঘটিত হয়। নিচে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কারণ এবং সংঘটনের প্রক্রিয়া বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:

১. বঙ্গভঙ্গের কারণ
প্রশাসনিক যুক্তি:

ব্রিটিশ সরকার দাবি করে যে বাংলা প্রদেশটি অতিরিক্ত বড় এবং প্রশাসনিকভাবে পরিচালনা করা কঠিন। তাই তারা বাংলা প্রদেশকে দুটি ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়।
‘ভাগ করে শাসন’ নীতি:

বাস্তবে, ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা। বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল করতে চেয়েছিল।
অর্থনৈতিক স্বার্থ:

বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বঙ্গের মুসলিম কৃষকদের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু জমিদারদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতো, যা ব্রিটিশদের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করত।
২. বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা
১৬ অক্টোবর, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করে। বাংলা প্রদেশকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়:
পশ্চিম বাংলা: যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিক্য ছিল।
পূর্ব বাংলা ও আসাম: যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি ছিল।
৩. বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ:

বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা বাঙালি সমাজে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে বিক্ষোভ, মিছিল, এবং সভার আয়োজন করা হয়।
স্বদেশী আন্দোলন:

ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের আহ্বান জানানো হয়। স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ ব্রিটিশ অর্থনীতিকে দুর্বল করতে চেয়েছিল।
রাখীবন্ধন উৎসব:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে রাখীবন্ধন উৎসব পালিত হয়, যা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জাতীয়তাবাদী সাহিত্য ও সংগীত:

সাহিত্যিক ও কবিরা তাঁদের রচনায় জাতীয়তাবাদী চেতনা উজ্জীবিত করেন। গান, কবিতা ও নাটকের মাধ্যমে আন্দোলনের বার্তা প্রচারিত হয়।
৪. আন্দোলনের নেতৃত্ব
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ ঘোষ, বিপিন চন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায় প্রমুখ নেতারা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা জনগণকে সংগঠিত করে আন্দোলনকে শক্তিশালী করেন।

৫. আন্দোলনের পদ্ধতি
বয়কট ও পিকেটিং:

ব্রিটিশ স্কুল, কলেজ, আদালত এবং পণ্য বর্জন করা হয়। জনগণ দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত হয়।
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন:

ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার বিপরীতে দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়।
প্রচার ও প্রচারণা:

পত্রিকা, পুস্তিকা এবং সভার মাধ্যমে আন্দোলনের বার্তা প্রচার করা হয়।
৬. ব্রিটিশ সরকারের প্রতিক্রিয়া
ব্রিটিশ সরকার আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে। তারা কঠোর আইন প্রয়োগ করে এবং নেতাদের গ্রেফতার করে।
৭. আন্দোলনের ফলাফল
বঙ্গভঙ্গের বাতিল:

আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল করে। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা আবার একত্রিত হয়।
জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান:

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে। এটি পরবর্তী স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
৮. দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক:

যদিও আন্দোলনে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য দেখা যায়, তবে পরবর্তীতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বাড়তে থাকে।
রাজনৈতিক সংগঠনের বিকাশ:

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট হয়। মুসলিম লীগ ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করে।
৯. সাংস্কৃতিক প্রভাব
সাহিত্য, শিল্প ও সংগীতে জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কবিতা জনগণকে অনুপ্রাণিত করে।
১০. ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের স্থান
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম ব্যাপক গণআন্দোলন হিসেবে গণ্য হয়। এটি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
সংক্ষেপে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ব্রিটিশ সরকারের বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি জনগণের প্রতিবাদ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থানের প্রতিফলন। এই আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।

আহমেদ রুসেল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024

বিভাগসমূহ