বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্য ও উদযাপন পদ্ধতি কী?

46 বার দেখাইতিহাসঐতিহ্য নববর্ষ বাংলা
0

বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্য ও উদযাপন পদ্ধতি কী?

মুহাম্মদ ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024
0

বাংলা নববর্ষ, যা পহেলা বৈশাখ নামে পরিচিত, বাংলার মানুষের জন্য একটি বিশেষ উৎসব। প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল (বাংলাদেশে) এবং ১৫ই এপ্রিল (ভারতে) এই দিনটি পালিত হয়। এটি বাংলা সনের প্রথম দিন এবং বাংলা সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক।

ঐতিহ্য ও ইতিহাস
উৎপত্তি ও প্রেক্ষাপট

মুঘল সম্রাট আকবরের সময়: বাংলা সনের উৎপত্তি মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৫৬-১৬০৫) হয়। ফসলি কর সংগ্রহের সুবিধার্থে তিনি হিজরি সন সংশোধন করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন, যা ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল।
সৌর পঞ্জিকা অনুসরণ: বাংলা সন সৌর পঞ্জিকা অনুসারে চলে, যা বৈশাখ মাস দিয়ে শুরু হয়।
ঐতিহ্যবাহী কার্যক্রম

কর আদায় ও উৎসব: অতীতে পহেলা বৈশাখ ছিল কৃষকদের জন্য কর পরিশোধের দিন। কর পরিশোধের পর জমিদাররা কৃষকদের মিষ্টি ও উপহার প্রদান করতেন।
হালখাতা: ব্যবসায়ীরা নববর্ষ উপলক্ষে পুরাতন হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব বই ‘হালখাতা’ উদ্বোধন করেন। এই দিনে তারা ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান।
উদযাপন পদ্ধতি
সকালের আয়োজন

সূর্যোদয়ের সাথে সাথে উদযাপন: পহেলা বৈশাখের সকালে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে উদযাপন শুরু হয়।
রমনা বটমূলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান: বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে রবি ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি পরিবেশিত হয়।
মঙ্গল শোভাযাত্রা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ: ১৯৮৯ সাল থেকে চারুকলা অনুষদের ছাত্রছাত্রীরা মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করে।
শোভাযাত্রার বৈশিষ্ট্য: রঙ-বেরঙের মুখোশ, পুতুল, প্রাণীর প্রতিকৃতি, এবং ব্যানার নিয়ে শোভাযাত্রা বের হয়, যা শুভ শক্তির জয় ও অশুভ শক্তির পরাজয়ের প্রতীক।
ইউনেস্কো স্বীকৃতি: ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো ‘মানবতার অমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
খাবার ও পানীয়

পান্তা ইলিশ: পহেলা বৈশাখে পান্তা ভাত (জলে ভেজানো ভাত) ও ইলিশ মাছ ভাজা খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এর সাথে লবণ, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি পরিবেশন করা হয়।
মিষ্টি ও ফলমূল: মিষ্টান্ন, দই, বিভিন্ন ধরনের ফলমূল খাওয়ার রীতি রয়েছে।
পোশাক ও সাজসজ্জা

ঐতিহ্যবাহী পোশাক: মহিলারা পরেন সাদা-লাল শাড়ি, পুরুষেরা পরেন পাঞ্জাবি ও ধুতি বা পায়জামা।
আলপনা ও গৃহসজ্জা: বাড়ির আঙিনায় রঙিন আলপনা আঁকা হয়। ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

গান, নাচ ও কবিতা আবৃত্তি: বিভিন্ন স্থানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, যেখানে লোকগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি পরিবেশিত হয়।
মেলাঃ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়, যেখানে হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প, খাবার ইত্যাদি পাওয়া যায়।
বিশেষ অনুষ্ঠান ও প্রথা

নাগরদোলা ও খেলাধুলা: শিশুদের জন্য নাগরদোলা, বায়স্কোপ ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকে। বিভিন্ন গ্রামীণ খেলাধুলার প্রতিযোগিতা হয়।
প্রার্থনা ও শুভ কামনা: মন্দির, মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন হয়। নতুন বছরের জন্য সবার মঙ্গল কামনা করা হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গে উদযাপন
তারিখ: পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নববর্ষ সাধারণত ১৫ই এপ্রিল পালিত হয়।
উদযাপন পদ্ধতি: বাংলাদেশের মতোই পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ উদযাপিত হয়। ব্যবসায়ীরা হালখাতা করেন, মিষ্টিমুখ করান।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য: কলকাতায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা ও প্রর্দশনী আয়োজন করা হয়।
আঞ্চলিক বৈচিত্র্য
চট্টগ্রাম ও পার্বত্য অঞ্চল: বিশেষ ধরনের নৃত্য ও সঙ্গীতের আয়োজন হয়। আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব রীতি রয়েছে।
সিলেট ও ময়মনসিংহ: লোকসংগীত ও ধামাইল নৃত্যের মাধ্যমে উদযাপন করা হয়।
বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব
সাংস্কৃতিক পরিচয়: বাংলা নববর্ষ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক।
সামাজিক ঐক্য: এই দিনটি সকল ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণীর মানুষ একসাথে উদযাপন করেন, যা সামাজিক ঐক্যের প্রতীক।
আনন্দ ও উদ্দীপনা: নববর্ষ নতুন আশা, উদ্দীপনা ও আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে।
উপসংহার
বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। পহেলা বৈশাখের উদযাপন শুধু একটি উৎসব নয়, বরং এটি বাঙালির জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন। এ দিনটি নতুন আশা, সম্ভাবনা ও প্রেরণার বার্তা নিয়ে আসে, যা সমগ্র জাতিকে একসূত্রে বেঁধে রাখে। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্য ও উদযাপন পদ্ধতি বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বমঞ্চে বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মুহাম্মদ ইকবাল প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 10, 2024

বিভাগসমূহ