ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) কেন বিতর্কিত?
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) কেন বিতর্কিত?
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ২০১৯ সালে ভারতের সংসদে গৃহীত একটি আইন, যা ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে সংশোধন আনে। এই আইনের মাধ্যমে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আসা নির্দিষ্ট ছয়টি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের (হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি ও খ্রিস্টান) ব্যক্তিদের জন্য ভারতের নাগরিকত্ব লাভের প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। তবে এই আইনে মুসলিম শরণার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যা বিভিন্ন বিতর্ক ও বিরোধের সৃষ্টি করেছে।
বিতর্কের মূল কারণসমূহ
১. ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য
সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি: ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষতার উপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো বৈষম্য নেই। CAA-তে নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষদের নাগরিকত্ব প্রদানে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, যা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সাথে সাংঘর্ষিক বলে সমালোচকরা মনে করেন।
মুসলিমদের বাদ দেওয়া: পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে আসা মুসলিম শরণার্থীদের এই আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এটি ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২. মৌলিক অধিকার ও সমতার লঙ্ঘন
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪: এই অনুচ্ছেদে সকলের জন্য আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন যে CAA এই সমতার নীতি লঙ্ঘন করছে।
৩. আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যাসমূহ
আঞ্চলিক পরিচয় ও সংস্কৃতি রক্ষা: আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেক মানুষ মনে করেন যে বহিরাগতদের নাগরিকত্ব প্রদান তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে।
অসম চুক্তির লঙ্ঘন: ১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পরে আসামে আসা সকল অভিবাসীকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল। CAA এই তারিখকে পরিবর্তন করে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ করেছে, যা অসম চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক।
৪. জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (NRC) নিয়ে উদ্বেগ
NRC ও CAA-এর সংযোগ: সমালোচকরা আশঙ্কা করেন যে CAA ও NRC একসাথে প্রয়োগ করা হলে মুসলিম জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। NRC-এর মাধ্যমে যেসব মানুষ নাগরিকত্ব প্রমাণে ব্যর্থ হবেন, তাঁরা যদি মুসলিম হন তবে তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
৫. শরণার্থী ও অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ
অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়: CAA-তে শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার বা নেপালের শরণার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যেমন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থীরা এই আইনের আওতায় পড়েন না।
ধর্মীয় অত্যাচার থেকে বাঁচা সকলের অধিকার: সমালোচকরা মনে করেন যে ধর্মীয় অত্যাচার থেকে বাঁচা সকল শরণার্থীরই সমান অধিকারের প্রাপ্য, ধর্ম নির্বিশেষে।
৬. মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
আন্তর্জাতিক সমালোচনা: বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও মানবাধিকার সংগঠন CAA-কে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার নীতির পরিপন্থী বলে বিবেচনা করেছে।
জাতিসংঘের উদ্বেগ: জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার এই আইনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
৭. সামাজিক অস্থিরতা ও প্রতিবাদ
বিক্ষোভ ও আন্দোলন: CAA পাস হওয়ার পর দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়, যা কিছু ক্ষেত্রে হিংসাত্মক রূপ নেয়।
সামাজিক সম্প্রীতির ক্ষতি: এই আইনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়, যা সামাজিক সম্প্রীতির জন্য হুমকি।
সরকারের যুক্তি
প্রতিবেশী দেশের সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা: সরকার দাবি করে যে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা অত্যাচারের শিকার, তাই তাঁদের সুরক্ষা প্রদান ভারতের দায়িত্ব।
দেশের নিরাপত্তা: অবৈধ অভিবাসন রোধ করে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
উপসংহার
ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের কারণে বিতর্কিত হয়েছে। সমালোচকরা মনে করেন যে এটি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমতার নীতি লঙ্ঘন করছে এবং দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে। এছাড়া, আসাম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের আঞ্চলিক সমস্যা ও সংস্কৃতি রক্ষার বিষয়টিও বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে। সামাজিক অস্থিরতা ও আন্তর্জাতিক সমালোচনার মধ্যেও সরকার তাদের অবস্থানে অটল রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা গুরুত্বপূর্ণ।