সিপাহী বিদ্রোহে বাংলার সৈনিকদের ভূমিকা কী ছিল?

118 বার দেখাইতিহাসবাংলা সিপাহী বিদ্রোহ সৈনিক
0

সিপাহী বিদ্রোহে বাংলার সৈনিকদের ভূমিকা কী ছিল?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
0

সিপাহী বিদ্রোহ, যা ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মহাবিদ্রোহ নামেও পরিচিত, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের (সিপাহীদের) পরিচালিত একটি ব্যাপক বিদ্রোহ ছিল। এই বিদ্রোহে বাংলার সৈনিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, বিশেষ করে কলকাতা, ঢাকা এবং মুর্শিদাবাদসহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের সিপাহীরা বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন।

নিচে সিপাহী বিদ্রোহে বাংলার সৈনিকদের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু প্রধান দিক তুলে ধরা হলো:

১. বেঙ্গল আর্মির বিদ্রোহ:
সিপাহী বিদ্রোহের প্রধান ভিত্তি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে থাকা ভারতীয় সেনাবাহিনী, বিশেষত বেঙ্গল আর্মি। বেঙ্গল আর্মি ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বৃহত্তম এবং শক্তিশালী সেনাবাহিনী, এবং এর সদস্যরা বেশিরভাগই বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সৈনিক ছিল। বেঙ্গল আর্মির অনেক সিপাহী ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল, বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক বিশ্বাসের প্রতি ব্রিটিশদের অসংবেদনশীল আচরণের কারণে। তাদের মধ্যে জমে থাকা অসন্তোষ বিদ্রোহের সময় জোরালো হয়ে ওঠে।

২. ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অসন্তোষ:
বাংলার সিপাহীরা, যাদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম উভয়ই ছিল, ব্রিটিশদের দ্বারা চাপানো নতুন রীতি ও আইন নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল। বিশেষ করে এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজে গরু এবং শূকরের চর্বি ব্যবহারের গুজব ছড়িয়ে পড়ার ফলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছিল। হিন্দু সিপাহীদের গরুকে এবং মুসলিম সিপাহীদের শূকরকে ধর্মীয়ভাবে অপবিত্র বলে মনে করা হতো, এবং এই কার্তুজ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করেছিল। এই ধরনের অপমানজনক আচরণের প্রতিক্রিয়ায় বাংলার সিপাহীরা বিদ্রোহে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়।

৩. মুর্শিদাবাদের বিদ্রোহ:
বাংলার মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে বিদ্রোহের উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। মুর্শিদাবাদ ছিল বাংলার ঐতিহাসিক শহর, যা নবাবী শাসনের কেন্দ্র ছিল। যদিও মুর্শিদাবাদ সরাসরি বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল না, তবুও সেখানে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সমর্থন ছিল এবং বিদ্রোহী সিপাহীরা এই অঞ্চলে সমর্থন ও সহযোগিতা লাভ করে।

4. কলকাতা এবং ঢাকায় প্রভাব:
কলকাতা, যা ছিল ব্রিটিশ শাসনের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র, বিদ্রোহের সময় সরাসরি বিদ্রোহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়নি, তবে এখানকার সিপাহীদের মধ্যেও অসন্তোষ বিরাজ করছিল। ঢাকায়ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা যায়। তবে ব্রিটিশ শাসন কলকাতা ও ঢাকায় সিপাহী বিদ্রোহ দমনের জন্য শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়, ফলে এই অঞ্চলে বড় আকারের বিদ্রোহ সংগঠিত হতে পারেনি।

৫. ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনের অংশগ্রহণ:
বাংলার সিপাহীরা শুধু সামরিক বিদ্রোহেই নয়, বরং ব্রিটিশ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা গ্রামাঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কৃষক ও সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভ করে এবং তাদের সহায়তা করে। বাংলার কিছু অংশে স্থানীয় নেতারা বিদ্রোহী সিপাহীদের সহযোগিতা করেন এবং ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইয়ে অংশ নেন।

৬. বিদ্রোহ দমন এবং পরিণতি:
সিপাহী বিদ্রোহের পরে বাংলার সৈনিকদের ওপর কঠোর দমননীতি প্রয়োগ করা হয়। ব্রিটিশ শাসন বিদ্রোহ দমনের জন্য অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং বেঙ্গল আর্মির অনেক সিপাহীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় বা শাস্তি দেওয়া হয়। বাংলার অনেক অংশে ব্রিটিশ শাসনের কড়া পদক্ষেপের ফলে বিদ্রোহী সিপাহীরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং বিদ্রোহ নির্মূল করা হয়।

৭. বাংলার জাতীয়তাবাদের জন্ম:
যদিও সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তীতে সফল হয়নি, তবে বাংলার সিপাহীদের অংশগ্রহণ বাংলার জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বিরোধিতার বীজ বপন করে। এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাংলার অনেক মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে দাঁড়ানোর প্রেরণা পায়, যা পরবর্তীকালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন করে।

সারসংক্ষেপ:
সিপাহী বিদ্রোহে বাংলার সৈনিকদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য, যদিও বাংলায় সরাসরি বিদ্রোহটি উত্তর ভারতের মতো ব্যাপক আকার ধারণ করেনি। বাংলার সিপাহীরা ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক কারণে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল এবং তাদের অসন্তোষ ব্রিটিশ শাসনের প্রতি গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল। এই বিদ্রোহ বাংলার মানুষের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের বিকাশ ঘটায় এবং পরবর্তী সময়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মঞ্চ প্রস্তুত করে।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024

বিভাগসমূহ