বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

0

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
0

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার জনগণের একটি ঐতিহাসিক প্রতিবাদ। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ শাসকরা বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত নিলে সাধারণ জনগণ তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং এর ফলস্বরূপ পুরো বাংলায় বিশাল গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং তাদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল বহুমুখী। নিচে এ বিষয়ে কিছু মূল দিক তুলে ধরা হলো:

১. প্রাথমিক বিস্ময় ও ক্ষোভ:
বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে বাংলার সাধারণ মানুষ প্রথমে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ব্রিটিশরা প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করার যুক্তি দেখালেও জনগণের মধ্যে এই বিভক্তিকে বাংলার ঐক্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখা হয়। ফলে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল ক্ষোভ এবং প্রতিবাদ।

২. সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত:
বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা এবং আসামকে একত্রিত করে একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল সৃষ্টি করা হয়, যা বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসেবে দেখা হয়। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের জনগণ ভাষা ও সংস্কৃতিগত ঐক্যকে রক্ষা করতে চেয়েছিল। তারা মনে করেছিল যে এই বিভাজন বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর একটি হুমকি।

৩. বর্জন ও স্বদেশী আন্দোলন:
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের অন্যতম প্রধান প্রতিক্রিয়া ছিল ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের আহ্বান। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা ব্রিটিশদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার চেষ্টা করে। “বর্জন আন্দোলন” এবং “স্বদেশী আন্দোলন” এর মাধ্যমে দেশীয় পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়। সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ কাপড়, লবণ, চিনি ইত্যাদি পণ্য বর্জন করে দেশীয় পণ্য ব্যবহার শুরু করে।

৪. বিক্ষোভ ও মিছিল:
বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারা বাংলায় ব্যাপক বিক্ষোভ এবং মিছিল সংঘটিত হয়। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সাধারণ জনগণ বিক্ষোভে যোগ দেয়। তারা বিভিন্ন স্থানে সভা-সমিতি করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। এসব মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শিক্ষিত শ্রেণির পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক, দোকানদারসহ নানা শ্রেণির মানুষ ছিল।

৫. সংগঠন ও একত্রিতকরণ:
বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাংলার জনগণকে রাজনৈতিকভাবে আরও সংগঠিত করে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মতো রাজনৈতিক সংগঠনগুলি সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং তাদের নেতৃত্বে আন্দোলন গতি পায়। অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের মতো বিপ্লবী সংগঠনগুলিও সাধারণ মানুষকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত করে তুলেছিল।

৬. মুসলিম সম্প্রদায়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়া:
বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। মুসলিম নেতাদের একটি অংশ বঙ্গভঙ্গকে সমর্থন করেছিল, কারণ তারা মনে করেছিল যে এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সহায়ক হবে। তবে সাধারণ মুসলিম জনগণের মধ্যে অনেকেই বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বিভক্ত বাংলাকে নিজেদের ঐতিহ্যের উপর আঘাত হিসেবে দেখেছিল এবং তারা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।

৭. নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ:
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বাংলার নারীরাও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তারা বর্জন আন্দোলনে অংশ নিয়ে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্যের ব্যবহার প্রচার করেছিল। বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নারী সমাজ আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছিল, যা তখনকার সমাজে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল।

৮. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আন্দোলন:
বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ছাত্ররা স্কুল ও কলেজে বিক্ষোভ ও ধর্মঘট পালন করে এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানায়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বদেশী আন্দোলনের প্রচারক হিসেবে ছাত্ররা কাজ করেছিল এবং ব্রিটিশ পণ্য বর্জনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।

৯. বিপ্লবী কার্যক্রমের প্রসার:
বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত বিপ্লবীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে এবং এর ফলে অনেক তরুণ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। তারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের পরিকল্পনা করে এবং স্বদেশী আদর্শকে সমর্থন করে। অরবিন্দ ঘোষ, বিনয় বসু, বাঘা যতীন প্রমুখ বিপ্লবীরা বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১০. গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া:
শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকায়ও বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করে এবং বিভিন্ন মিছিল ও সভায় অংশগ্রহণ করে। গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণির লোকেরাও এই আন্দোলনে নিজেদের অবস্থান সুস্পষ্ট করে।

১১. ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ঐক্য:
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় বিভেদকে অতিক্রম করে হিন্দু-মুসলমান একত্রিত হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তকে তারা বাংলার ঐক্য এবং স্বাধীনতা হরণের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখেছিল। যদিও পরবর্তীকালে কিছু রাজনৈতিক কৌশল ধর্মীয় বিভেদের সূচনা করেছিল, তবুও সাধারণ মানুষ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছিল।

১২. সংস্কৃতি ও সাহিত্য জগতের অবদান:
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি ও সাহিত্য জগতেও এর প্রভাব পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন “আমার সোনার বাংলা” গানটি, যা সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক অনুপ্রেরণা যোগায় এবং বাংলার ঐক্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সেই সময়ের কবিতা, গান, প্রবন্ধ এবং নাটকে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সুর ধ্বনিত হয়।

১৩. জনমতের চাপ এবং বঙ্গভঙ্গ রদ:
সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার ফলে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের প্রভাব উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়। ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত রদ করে এবং বাংলা পুনরায় একত্রিত হয়। এটি ছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য, যা সাধারণ জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার ফসল।

১৪. বঙ্গভঙ্গের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব:
যদিও বঙ্গভঙ্গ রদ হয়, কিন্তু এই আন্দোলন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধের সঞ্চার ঘটে এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার মানসিকতা গড়ে ওঠে। এছাড়া, বর্জন আন্দোলন এবং স্বদেশী ভাবনা ভারতের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে, যা পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বড় ভূমিকা রাখে।

সারসংক্ষেপে, বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া ছিল তীব্র ও ঐক্যবদ্ধ। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে এবং তারা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তারা স্বদেশী আন্দোলনের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং ভবিষ্যতের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করে।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
আপনি 1 উত্তরের মধ্যে 1টি দেখছেন, সব উত্তর দেখতে এখানে ক্লিক করুন।

বিভাগসমূহ