মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম কী ছিল?
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের কার্যক্রম কী ছিল?
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার, যা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস অভিযানের পরে ১০ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে এই সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (যা পরে মুজিবনগর নামে পরিচিত হয়) আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।
প্রবাসী সরকারের প্রধান কার্যক্রম
১. মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও সমন্বয়
মুক্তিবাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণ:
মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা এবং সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
সেক্টর কমান্ডারদের নিয়োগ এবং সেক্টর ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা।
গেরিলা যুদ্ধ কৌশল প্রণয়ন:
পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি।
২. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
বিশ্ববাসীর কাছে যুদ্ধের বাস্তবতা উপস্থাপন:
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার তথ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরা।
বিদেশি সরকার ও সংগঠনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন:
ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সমর্থন অর্জন।
অন্যান্য দেশ ও জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতি ও সমর্থনের আবেদন।
৩. শরণার্থীদের সহায়তা ও ব্যবস্থাপনা
শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন:
ভারতে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর জন্য খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।
শরণার্থী শিবিরের পরিচালনা:
শরণার্থী শিবিরগুলির পরিচালনা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।
৪. প্রশাসনিক কাঠামো ও নীতি প্রণয়ন
মন্ত্রিসভা গঠন:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয় (যদিও তিনি পাকিস্তানে আটক ছিলেন)।
সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়।
প্রশাসনিক দপ্তর স্থাপন:
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তর গঠন করে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা।
আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন:
ভবিষ্যৎ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নীতি ও আইন প্রণয়ন।
৫. মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি
প্রচার ও প্রেরণা:
রেডিও, পত্রিকা ও অন্যান্য মাধ্যমে প্রচার করে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধির চেষ্টা।
সংগীত ও সংস্কৃতির ব্যবহার:
দেশাত্মবোধক গান ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণকে উদ্দীপ্ত করা।
৬. অর্থ সংগ্রহ ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা
আর্থিক সহায়তা সংগ্রহ:
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও প্রবাসী বাঙালিদের কাছ থেকে অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহ।
সামরিক ও অসামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ:
অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ ও বিতরণ।
৭. সংবাদ ও তথ্য প্রচার
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র:
রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে সংবাদ, নির্দেশনা ও প্রেরণাদায়ক বার্তা প্রচার।
গণমাধ্যমের সাথে যোগাযোগ:
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের সংগ্রামের খবর পৌঁছে দেওয়া।
প্রবাসী সরকারের গুরুত্ব ও অবদান
মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান:
সামগ্রিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনা ও সমন্বয়ে প্রবাসী সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন:
ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও পরবর্তীতে অন্যান্য দেশের সহানুভূতি ও সমর্থন অর্জনে সফল হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন:
প্রশাসনিক কাঠামো, নীতি ও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখে।
উপসংহার
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। যুদ্ধ পরিচালনা, আন্তর্জাতিক সমর্থন অর্জন, শরণার্থীদের সহায়তা ও প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের মাধ্যমে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাদের ত্যাগ ও নিষ্ঠা জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।