বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী?

75 বার দেখাভূগোলজলবায়ু বাংলাদেশ
0

বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 11, 2024
0

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, যার ভৌগোলিক অবস্থান ও সমুদ্রপৃষ্ঠের নিকটবর্তীতা এটিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল করে তুলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়েছে, যা দেশের অর্থনীতি, সমাজ ও পরিবেশের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান প্রভাবসমূহ
১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি

ভূমি হারানো ও জলমগ্নতা:
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে।
বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলে জলমগ্নতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কৃষি জমি, বসতি ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
অনুমান করা হয় যে আগামী কয়েক দশকে দেশের প্রায় ১৭% ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে হারিয়ে যেতে পারে।
২. ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বৃদ্ধি

প্রকোপ বৃদ্ধি:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় সিডর (২০০৭), আইলা (২০০৯), রোয়ানু (২০১৬), আম্পান (২০২০) ইত্যাদি এর উদাহরণ।
ক্ষয়ক্ষতি:
ঘূর্ণিঝড়ের ফলে জলোচ্ছ্বাস হয়, যা উপকূলীয় এলাকায় প্রাণহানি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি করে।
অবকাঠামো, কৃষি, মৎস্য সম্পদ ও বাসস্থান ধ্বংস হয়।
৩. বন্যা ও প্লাবন

অত্যধিক বৃষ্টিপাত:
বর্ষাকালে অস্বাভাবিক ও অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে নদীর পানি বৃদ্ধি পায়।
নদী ভাঙন ও প্লাবনের কারণে ফসলহানি, বসতি ক্ষতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিঘ্ন ঘটে।
ফ্ল্যাশ ফ্লাড:
পাহাড়ি এলাকায় আকস্মিক বন্যা ঘটে, যা জীবিকা ও সম্পদের ক্ষতি করে।
৪. খরা ও জল সংকট

বৃষ্টিপাতের অনিয়মিততা:
শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টিপাতের অভাবে খরা দেখা দেয়, যা কৃষি উৎপাদনে প্রভাব ফেলে।
উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খরার কারণে ফসলহানি ও পানির সংকট দেখা দেয়।
জল সংকট:
সুপেয় জলের অভাব, ভূগর্ভস্থ জলের স্তর হ্রাস ও লবণাক্ততার বৃদ্ধি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।
৫. লবণাক্ততার বৃদ্ধি

মাটির লবণাক্ততা:
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে উপকূলীয় এলাকার মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর ফলে কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে, যা কৃষকদের জীবিকায় প্রভাব ফেলে।
পানীয় জলের লবণাক্ততা:
লবণাক্ততার কারণে সুপেয় জলের উৎস দূষিত হচ্ছে, যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়।
৬. কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব

ফসলহানি:
বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলহানি ঘটে।
খাদ্য উৎপাদনে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে।
ফসলের বৈচিত্র্য হ্রাস:
কিছু ফসল জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না, ফলে ফসলের বৈচিত্র্য হ্রাস পাচ্ছে।
৭. জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি

সুন্দরবনের ক্ষতি:
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হুমকির মুখে।
লবণাক্ততা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ঘূর্ণিঝড়ের ফলে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রজাতির বিলুপ্তি:
বাঘ, কুমির, ডলফিনসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন।
৮. স্বাস্থ্যঝুঁকি ও রোগের প্রাদুর্ভাব

জলবাহিত রোগ:
বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েডের মতো রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।
ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু:
তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলাবদ্ধতার কারণে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তাপপ্রবাহের প্রভাব:
তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে তাপপ্রবাহ দেখা দেয়, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
৯. পরিবেশগত উদ্বাস্তু ও অভিবাসন

বাসস্থান হারানো:
বন্যা, নদী ভাঙন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মানুষ বসতি হারাচ্ছে।
অভিবাসন:
গ্রামীণ এলাকা থেকে মানুষ শহরে বা অন্য দেশে অভিবাসন করছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
১০. অর্থনৈতিক ক্ষতি

বৃহৎ অর্থনৈতিক ক্ষতি:
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অবকাঠামো, কৃষি, মৎস্য ও শিল্পখাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
উন্নয়ন ব্যাহত:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন কার্যক্রমকে ব্যাহত করে।
সমাধান ও উদ্যোগ
সরকারি পদক্ষেপ

জাতীয় অভিযোজন কর্মপরিকল্পনা (NAP):
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
বাঁধ ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামো নির্মাণ:
উপকূলীয় এলাকায় বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ।
কৃষিতে অভিযোজন:
লবণ সহনশীল ও খরা সহনশীল ফসলের উন্নয়ন ও প্রচলন।
জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড:
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আর্থিক সহায়তা প্রদান।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন (COP):
বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
অর্থায়ন ও প্রযুক্তি স্থানান্তর:
উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে অর্থায়ন ও প্রযুক্তি সহায়তা গ্রহণ।
সচেতনতা ও শিক্ষা

সচেতনতা বৃদ্ধি:
জনগণের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ:
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক শিক্ষা।
উপসংহার
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ, যা দেশের পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের উপর বহুমুখী প্রভাব ফেলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি দেশের স্থায়িত্ব ও উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার, জনগণ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তির ব্যবহার, সচেতনতা বৃদ্ধি ও অভিযোজন কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে প্রশমিত করতে সক্ষম হবে।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 11, 2024

বিভাগসমূহ