তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সমস্যা কী?

0

তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত সমস্যা কী?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
0

তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি সমস্যা বিদ্যমান, যা উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সংক্রান্ত এই বিরোধ বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে তীব্র আকার ধারণ করে, যখন নদীর পানির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় এবং উভয় দেশেই চাষাবাদ ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পানির প্রাপ্যতা নিয়ে এই সমস্যা দুই দেশের অর্থনীতি, কৃষি এবং সম্পর্ককে প্রভাবিত করছে।

নিচে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

১. তিস্তা নদীর পরিচিতি:
তিস্তা নদী ভারতের সিকিম রাজ্যের হিমালয় অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবেশ করে এবং ব্রহ্মপুত্র নদীতে মিশে যায়। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার, যার প্রায় ১২৫ কিলোমিটার বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। তিস্তা নদীর পানি উভয় দেশের কৃষি এবং অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

২. পানিবণ্টন চুক্তির প্রেক্ষাপট:
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তির আলোচনা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। ১৯৮৩ সালে একটি সাময়িক চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশ তিস্তার পানির ৩৯ শতাংশ ভারত এবং ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশকে দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছেছিল। কিন্তু এটি ছিল অস্থায়ী চুক্তি এবং এখনো পর্যন্ত কোনো স্থায়ী চুক্তি হয়নি। দুই দেশের মধ্যে পানির বণ্টন নিয়ে এখনো আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, কিন্তু একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

৩. শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতি:
বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর পানির পরিমাণ অনেক কমে যায়। এই সময়ে পানির প্রাপ্যতা বাংলাদেশের কৃষি, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম জেলার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাবে এসব অঞ্চলে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়, যা খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষকের জীবিকা হুমকির মধ্যে ফেলে।

৪. গজলডোবা বাঁধের প্রভাব:
ভারত পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবা এলাকায় তিস্তা নদীর ওপর একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে, যার ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানির প্রবাহ অনেকাংশে কমে যায়। এই বাঁধের কারণে ভারত নদীর বেশিরভাগ পানি নিজের কৃষিকাজে ব্যবহার করে এবং এর ফলে বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। বাংলাদেশ শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানির অভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

৫. বাংলাদেশের দাবি:
বাংলাদেশের দাবি হলো, তিস্তার পানি দুই দেশের মধ্যে ন্যায্যভাবে ভাগ করা হোক, যাতে উভয় দেশের কৃষি এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বড় একটি অংশ তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল, এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি না পাওয়ার ফলে এসব অঞ্চলের কৃষকরা ফসল উৎপাদনে ব্যর্থ হন।

বাংলাদেশের প্রস্তাবিত স্থায়ী চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে তিস্তার পানির সমান বণ্টন হওয়া উচিত।
৬. ভারতের অবস্থান:
ভারত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ সরকার, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, তিস্তার পানি পশ্চিমবঙ্গের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পানির পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে রাজ্যের কৃষিকাজ এবং জীবিকার ওপরও প্রভাব পড়ে।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির কারণে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না।
৭. রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা:
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি কেবল দুই দেশের পরিবেশ ও অর্থনীতির বিষয় নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের মতানৈক্য এবং বাংলাদেশের চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এই ইস্যুটি বারবার উঠে আসছে, তবে এখনো পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছানো যায়নি।

৮. ভবিষ্যত সম্ভাবনা ও আলোচনা:
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একটি টেকসই সমাধান খুঁজে বের করার জন্য উভয় দেশের মধ্যে একটি যৌথ নদী কমিশন বা কার্যকরী আলোচনা প্রয়োজন। পানিবণ্টন নিয়ে সমস্যাটি কেবলমাত্র পানি সম্পর্কিত নয়, বরং এটি দুই দেশের সম্পর্ক এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপরও প্রভাব ফেলে।

সারসংক্ষেপ:
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সমস্যা চলছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতি, গজলডোবা বাঁধের প্রভাব, এবং দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। বাংলাদেশের দাবি অনুযায়ী পানির ন্যায্য বণ্টন এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন সমস্যার একটি টেকসই সমাধান পাওয়া কঠিন।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024

বিভাগসমূহ