বাংলা ভাষায় বানান সংস্কার নিয়ে বিতর্ক কী?
বাংলা ভাষায় বানান সংস্কার নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। বাংলা ভাষার বানান দীর্ঘ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় গঠিত, যার ফলে এর বেশ কিছু অংশ সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ভাষার পরিবর্তন, উচ্চারণের বিবর্তন এবং বানানের সঠিক মান নির্ধারণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়, যা প্রায়ই বিতর্কের রূপ ধারণ করেছে।
নিচে বাংলা বানান সংস্কার নিয়ে প্রধান বিতর্কগুলো তুলে ধরা হলো:
১. প্রমিত বানান বনাম আঞ্চলিক উচ্চারণের বিতর্ক:
বাংলা ভাষায় আঞ্চলিক উচ্চারণের ভিন্নতা অনেক বেশি। ফলে একই শব্দ বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। প্রমিত বাংলা (যা মূলত পশ্চিমবঙ্গের উচ্চারণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ) এবং বাংলাদেশের আঞ্চলিক উচ্চারণের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কিছু ভাষাবিদ মনে করেন যে, বানান সংস্কারের মাধ্যমে বানানকে উচ্চারণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা উচিত, আবার অন্যরা মনে করেন, এতে ভাষার ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে।
উদাহরণস্বরূপ, “গুরুত্ব” শব্দটি পশ্চিমবঙ্গে “গুরুত্ত্ব” হিসেবে উচ্চারিত হয়, কিন্তু বাংলাদেশের প্রমিত উচ্চারণে “গুরুত্ব”। এই পার্থক্য নিয়ে বিতর্ক হয় যে, বানান কি উচ্চারণ অনুযায়ী পরিবর্তন করা উচিত নাকি প্রমিত বানান হিসেবে রাখতে হবে।
২. সংস্কৃত বনাম চলিত বাংলা বানানের দ্বন্দ্ব:
বাংলা বানানের অনেক অংশে সংস্কৃত ভাষার প্রভাব স্পষ্ট। অনেক শব্দের বানান সংস্কৃত অনুসারে কঠিন এবং দীর্ঘ, যা অনেকের কাছে জটিল বলে মনে হয়। এর ফলে কিছু ভাষাবিদ ও লেখক সহজতর বানান সংস্কারের দাবি করেছেন, যা সাধারণ মানুষের জন্য বোধগম্য ও ব্যবহারযোগ্য হবে।
উদাহরণস্বরূপ, “সৎ” এবং “সত্” এর মতো শব্দগুলোর বানান সংস্কৃত অনুসারে থাকলেও উচ্চারণে কোনো পার্থক্য নেই। তাই অনেকে মনে করেন, এগুলোকে সহজ করে “সত” হিসেবে লেখা উচিত।
৩. বাংলাদেশ বনাম পশ্চিমবঙ্গের বানানভিত্তিক পার্থক্য:
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার বানান ও উচ্চারণের মধ্যে কিছু ভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রমিত ভাষা চলিত বাংলার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংস্কৃতঘেঁষা প্রমিত বানান ব্যবহার করা হয়। এই পার্থক্য নিয়ে দু’দেশের মধ্যে এক ধরনের বিতর্ক বিদ্যমান, বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমে বানান প্রয়োগে।
উদাহরণ হিসেবে, “বইয়ের” শব্দটি বাংলাদেশে “বইয়ের” হিসেবে লিখিত হয়, যেখানে পশ্চিমবঙ্গে “বইয়ে” লেখা হয়। এই ধরনের পার্থক্য অনেক ক্ষেত্রেই বানান নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
৪. ই-কার এবং ঈ-কারের ব্যবহার:
বাংলা বানানে ই-কার এবং ঈ-কার এর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বিতর্ক রয়েছে। অনেক সময় উচ্চারণে পার্থক্য না থাকলেও বানানে পার্থক্য থাকে। বিশেষ করে ই-কার এবং ঈ-কার নিয়ে শিক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়ে। যেমন, “বিধি” এবং “বিদি” শব্দের মধ্যে উচ্চারণের পার্থক্য না থাকলেও বানানে পার্থক্য রয়েছে, যা প্রায়ই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
অনেক ভাষাবিদ মনে করেন যে, বানান সংস্কারের মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোকে সমাধান করা উচিত।
৫. ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বৈত ব্যবহার:
বাংলা ভাষায় কিছু ব্যঞ্জনবর্ণ যেমন “য” এবং “জ”, “শ”, “ষ” এবং “স” এর মধ্যে উচ্চারণে পার্থক্য না থাকলেও বানানে পার্থক্য রয়েছে। এই কারণে অনেক সময় বানান শেখা কঠিন হয়ে যায়। যেমন, “শিক্ষা”, “ষড়যন্ত্র”, “সৎ” এর মতো শব্দগুলোতে এই ধরণের বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে যে, বাংলা ভাষার বানানকে সহজ এবং উচ্চারণভিত্তিক করা উচিত কি না।
৬. বহুজাতিক সংযোগ এবং আন্তর্জাতিকতা:
বাংলা বানান সংস্কার নিয়ে আরেকটি বড় বিতর্ক হলো, বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বানানকে আরও সহজ করা উচিত কিনা। অনেকে মনে করেন, যদি বাংলা ভাষার বানান সহজ করা হয়, তাহলে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও গ্রহণযোগ্য হবে এবং নতুন প্রজন্মের কাছে শেখা সহজ হবে।
৭. অভিধান সংক্রান্ত বিভ্রান্তি:
বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অভিধানে বানানের কিছু ভিন্নতা রয়েছে, যা প্রায়ই ব্যবহারকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ভাষার শুদ্ধ বানান নির্ধারণ নিয়ে বহুবার বিতর্ক হয়েছে এবং প্রমিত বাংলা অভিধান তৈরির দাবি উঠেছে, যাতে সবার জন্য নির্ধারিত বানান ব্যবস্থা প্রযোজ্য হয়।
৮. বাংলা একাডেমির ভূমিকা ও বিতর্ক:
বাংলা ভাষার প্রমিত বানান নির্ধারণে বাংলা একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে তাদের নির্ধারিত বানান সংস্কার নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, একাডেমির নির্ধারিত কিছু নিয়ম সময়োপযোগী নয় এবং তা আরও সহজ ও আধুনিক হওয়া উচিত। আবার অন্যরা মনে করেন, এই নিয়মগুলোর মধ্য দিয়ে ভাষার ঐতিহ্য ও শুদ্ধতা বজায় রাখা হচ্ছে।
সারসংক্ষেপ:
বাংলা ভাষায় বানান সংস্কার নিয়ে বিতর্ক মূলত প্রমিত ও আঞ্চলিক উচ্চারণ, সংস্কৃত ও চলিত বাংলার দ্বন্দ্ব, এবং ভাষার সহজীকরণ নিয়ে। বাংলা বানানের ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও উচ্চারণের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যদিও বাংলা বানান সংস্কারের প্রয়োজন নিয়ে অনেকেই একমত, তবে কোন পথে তা করা উচিত এবং কীভাবে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে সমন্বয় আনা যায়, তা নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে।