মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন কী?

0

মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন ও দর্শন কী?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
0

মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এবং উপমহাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি সাধারণত “মজলুম জননেতা” নামে পরিচিত ছিলেন, কারণ তিনি আজীবন শোষিত, নিপীড়িত ও দরিদ্র মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছেন। তার রাজনৈতিক জীবন এবং দর্শন স্বাধীনতা, শোষণমুক্ত সমাজ এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত ছিল।

নিচে মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন এবং দর্শন বিশদভাবে তুলে ধরা হলো:

১. রাজনৈতিক জীবনের শুরু:
মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবনের শুরু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সময়। তিনি খিলাফত আন্দোলন এবং নন-কোঅপারেশন মুভমেন্ট (অসহযোগ আন্দোলন) এর সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তার এই সংগ্রাম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের চেতনাকে উজ্জীবিত করতে সাহায্য করে।

২. মুসলিম লীগের সঙ্গে যুক্তি এবং পাকিস্তান আন্দোলন:
মাওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পূর্ব বাংলার মানুষদের জন্য রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বাধীনতার প্রশ্নে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সমর্থন দেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর, মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে থাকেন।

৩. আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্ব:
মাওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার এবং স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি মনে করতেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনমহল পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের শোষণ করছে এবং তাদের অধিকারকে উপেক্ষা করছে।

৪. ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা:
মাওলানা ভাসানী বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হন। তিনি বাংলার স্বায়ত্তশাসন এবং মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় তার অবদান উল্লেখযোগ্য।

৫. কৃষক ও মজুরের পক্ষে সংগ্রাম:
মাওলানা ভাসানী আজীবন শোষিত কৃষক, মজুর, এবং সাধারণ মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করেছেন। তিনি দেশের কৃষক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেন। ফরিদপুর, পাবনা, এবং টাঙ্গাইলে তিনি কৃষকদের নেতৃত্ব দেন এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেন।

বিশেষ করে, ১৯৫৪ সালের কাগমারী সম্মেলন ছিল কৃষক আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যেখানে ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের কৃষক ও মজুরদের জন্য স্বাধীনতার দাবি তোলেন।
৬. সুবেদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং ‘ফরিদপুরের জমিদার’:
মাওলানা ভাসানী ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব দেন এবং পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই বিদ্রোহে তার অন্যতম দাবিগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।

৭. ফারাক্কা লংমার্চ এবং পানি সমস্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম:
মাওলানা ভাসানী ফারাক্কা বাঁধের কারণে পূর্ব পাকিস্তান তথা পরবর্তীতে বাংলাদেশের পানি সমস্যার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে ফারাক্কা লংমার্চ পরিচালনা করেন, যা ভারতের ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর পানি প্রবাহে বাধা এবং বাংলাদেশের পানি সংকটের বিরুদ্ধে একটি জনআন্দোলন ছিল। এই লংমার্চের মাধ্যমে ভাসানী সাধারণ মানুষের সমস্যার প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।

৮. মাওলানা ভাসানীর সমাজতান্ত্রিক দর্শন:
মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শন মূলত সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিল। তিনি শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখতেন, যেখানে কৃষক ও শ্রমিকরা তাদের অধিকার এবং মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারবে। তিনি ধনী-গরিব বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং দেশের সম্পদকে সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করার পক্ষে ছিলেন।

তিনি পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে ন্যাপ (ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি) গঠন করেন, যা মূলত সমাজতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তার সমাজতান্ত্রিক দর্শনের কারণে তিনি শ্রেণিসংগ্রাম এবং শোষিতদের মুক্তির প্রশ্নে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
৯. বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা:
মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালোভাবে বক্তব্য রাখেন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন জোগাড়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীর মনোবল বৃদ্ধিতে কাজ করেছেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছেন। তার স্বাধীনতা সংগ্রামের অবদান জাতীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
১০. মৃত্যুর পরও প্রভাব:
মাওলানা ভাসানী তার মৃত্যুর পরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী। তার জীবন ও সংগ্রাম এখনো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের অনুপ্রাণিত করে। বিশেষ করে, দরিদ্র ও শোষিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার ভূমিকা এবং রাজনীতি আজও নতুন প্রজন্মের কাছে প্রাসঙ্গিক।

সারসংক্ষেপ:
মাওলানা ভাসানী ছিলেন একজন অসাধারণ নেতা এবং সমাজসেবক, যিনি শোষিত, নিপীড়িত এবং দরিদ্র মানুষের পক্ষে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন। তার রাজনৈতিক জীবন গণমানুষের অধিকার রক্ষা, স্বাধীনতা, স্বায়ত্তশাসন এবং সমাজতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাসী ছিল। তিনি কেবল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিয়েই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং নিজের দর্শন এবং কর্মের মাধ্যমে সমাজে পরিবর্তন আনতে সচেষ্ট ছিলেন। তার সংগ্রাম এবং আদর্শ বাংলাদেশের রাজনীতিতে চিরকালীন প্রভাব ফেলেছে, যা আজও নতুন প্রজন্মের নেতাদের প্রেরণা জোগায়।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে

বিভাগসমূহ