বাংলার হাতে তৈরি কাগজ শিল্পের ইতিহাস কী?

76 বার দেখাঅর্থনীতিইতিহাস কাগজ বাংলা শিল্প
0

বাংলার হাতে তৈরি কাগজ শিল্পের ইতিহাস কী?

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
0

বাংলার হাতে তৈরি কাগজ শিল্প ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এই শিল্পের শিকড় প্রাচীন বাংলায় অনেক আগে থেকেই প্রসারিত, এবং এর উৎপত্তি ও বিকাশে বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং রাজনৈতিক অবস্থার গভীর প্রভাব রয়েছে। বাংলার কাগজ শিল্প একসময় সমগ্র উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ ছিল এবং এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

নিচে বাংলার হাতে তৈরি কাগজ শিল্পের ইতিহাস বিশদভাবে আলোচনা করা হলো:

১. প্রাচীন ও মধ্যযুগে কাগজের ব্যবহার:
প্রাচীনকাল থেকে বাংলায় বিভিন্ন ধরনের লেখার উপাদান হিসেবে তাড়কা পাতা, ভোজপত্র, এবং খাগের ছাল ব্যবহার করা হতো। কাগজের প্রচলন শুরু হওয়ার আগে এগুলোই লেখার মাধ্যম ছিল। বাংলায় হাতে তৈরি কাগজের প্রচলন সম্ভবত মুসলিম শাসনামলে শুরু হয়, যখন চীনা কাগজ তৈরির পদ্ধতি ভারতবর্ষে আসে। এই পদ্ধতি বাংলায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং প্রাচীন বৌদ্ধ ও হিন্দু পুথি লেখার জন্য কাগজ ব্যবহার করা হতো।

২. মধ্যযুগে কাগজ শিল্পের উত্থান:
বাংলায় মধ্যযুগে বিশেষ করে মুঘল আমলে হাতে তৈরি কাগজ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাংলার নদী উপত্যকায় সহজলভ্য বাঁশ, তুঁত গাছের ছাল, এবং অন্যান্য উদ্ভিজ্জ উপাদান কাগজ তৈরির জন্য ব্যবহার করা হতো। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে কাগজ শিল্প বাংলায় বিশেষভাবে বিকাশ লাভ করে। তখন বই লেখা, দলিলপত্র তৈরি, এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে কাগজের ব্যবহার শুরু হয়। এই সময় বাংলায় তৈরি কাগজের গুণগত মান এতই ভালো ছিল যে তা মুঘল দরবারেও উচ্চ মর্যাদা পায়।

৩. সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা অঞ্চলে কাগজ শিল্পের বিকাশ:
বাংলায় হাতে তৈরি কাগজ শিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, এবং ঢাকা। এই অঞ্চলে কাগজ তৈরির কারিগরেরা নিজেদের শিল্পকর্মে নিপুণ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। বাঁশ ও তুঁত গাছের ছাল থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি কাগজ ছিল মসৃণ, মজবুত, এবং দীর্ঘস্থায়ী। এই কাগজগুলো কেবল স্থানীয় বাজারেই নয়, বরং দূর-দূরান্তে রপ্তানি করা হতো।

৪. মুঘল আমলে কাগজের চাহিদা:
মুঘল আমলে কাগজের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, কারণ তখন সরকারী কাজকর্ম এবং বই লেখার কাজে কাগজের ব্যাপক ব্যবহার ছিল। মুঘল শাসনের সময় বাংলার হাতে তৈরি কাগজ সরকারী প্রশাসনিক কাজ, রাজকীয় দলিলপত্র, এবং ধর্মীয় পুথি লেখার জন্য ব্যবহৃত হতো। এই সময় কাগজ শিল্প বিশেষভাবে প্রসার লাভ করে এবং মুঘল দরবারের জন্য কাগজ তৈরি করার কাজ বাংলার অনেক অঞ্চলে ছিল।

৫. ব্রিটিশ আমলে কাগজ শিল্পের সংকট:
ব্রিটিশ শাসনামলে হাতে তৈরি কাগজ শিল্প সংকটে পড়ে। ইংরেজরা মেশিনে তৈরি কাগজ ভারতে আমদানি করা শুরু করে এবং এর ফলে হাতে তৈরি কাগজের চাহিদা কমে যায়। ব্রিটিশ শাসনের ফলে এই শিল্প ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলে যায়, কারণ মেশিনে তৈরি কাগজ তুলনামূলকভাবে সস্তা এবং সহজলভ্য ছিল।

ব্রিটিশদের দ্বারা মেশিনে তৈরি কাগজের আমদানি এবং উৎপাদন শুরু হওয়ার ফলে হাতে তৈরি কাগজের উৎপাদনকারীরা তাদের শিল্প চালিয়ে যেতে অসুবিধায় পড়েন এবং অনেক কারিগর এই শিল্প ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
৬. স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে কাগজ শিল্প:
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাতে তৈরি কাগজ শিল্প পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে কারিগরদের প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা দেওয়া হয়। বিশেষ করে এনজিও এবং কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন হাতে তৈরি কাগজের শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছে।

হাতে তৈরি কাগজ এখন সাধারণত হস্তশিল্প, উপহার সামগ্রী, এবং স্মারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা বিভিন্ন পর্যটন মেলায় এবং সাংস্কৃতিক প্রদর্শনীতে স্থান পায়।
৭. কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া:
বাংলার হাতে তৈরি কাগজ তৈরির প্রক্রিয়া ছিল একটি বিশেষ দক্ষতার কাজ। বাঁশ, তুঁত গাছের ছাল, এবং অন্যান্য উদ্ভিজ্জ উপাদান থেকে গুঁড়া করে তা পানি এবং চুনের সাহায্যে প্রস্তুত করা হতো। তারপর মসৃণ পাথরের উপর এই মিশ্রণটি মুঠো দিয়ে ছড়িয়ে দিয়ে কাগজ তৈরি করা হতো। এর পর সেটিকে রোদে শুকিয়ে নিয়ে মসৃণ করার জন্য বিশেষ রোলার দিয়ে চাপ দেওয়া হতো।

সারসংক্ষেপ:
বাংলার হাতে তৈরি কাগজ শিল্পের ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। এই শিল্প প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়ে মুঘল আমলে বিশেষ বিকাশ লাভ করে এবং ব্রিটিশ শাসনামলে সংকটে পড়ে। হাতে তৈরি কাগজ বাংলার সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ছিল। যদিও মেশিনে তৈরি কাগজের চাপে এই শিল্প প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে এখনও হাতে তৈরি কাগজের ঐতিহ্যবাহী দক্ষতাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং এটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসেবে রয়ে গেছে।

ফয়সাল কবীর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024

বিভাগসমূহ