বাংলায় বিদেশি ভাষার শব্দ গ্রহণের উদাহরণ কী কী?
বাংলা ভাষায় বিদেশি ভাষার শব্দ গ্রহণের প্রক্রিয়া দীর্ঘ সময় ধরে চলেছে এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষা থেকে বহু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে। এই শব্দগুলোকে “অভ্রান্তভাবে” বলা যায় বিদেশি শব্দের বাংলা রূপ। বাংলা ভাষার গতিশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে এই শব্দগুলো ভাষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। নিচে কয়েকটি প্রধান বিদেশি ভাষা থেকে গ্রহণ করা শব্দ এবং তাদের উদাহরণ দেওয়া হলো:
১. ফারসি (পার্সি) ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
বাংলা ভাষায় ফারসি ভাষার প্রভাব মধ্যযুগে মুসলিম শাসনের সময়ে শুরু হয় এবং অনেক গুরুত্বপূর্ণ শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান পায়।
আদালত: ন্যায়বিচারের স্থান।
বাজার: কেনাবেচার স্থান।
দরবার: রাজপ্রাসাদ বা শাসকগোষ্ঠীর সভা।
চাবি: তালা খোলার যন্ত্র।
কিতাব: বই।
মকসুদ: উদ্দেশ্য।
রসিদ: পেমেন্টের প্রমাণপত্র।
২. আরবি ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
আরবি ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় মূলত ধর্মীয় ও প্রশাসনিক প্রেক্ষাপটে প্রবেশ করেছে।
আল্লাহ: ঈশ্বরের নাম।
নবী: ধর্মীয় দূত।
ইমান: বিশ্বাস।
হালাল: বৈধ বা ধর্মসম্মত।
দফতর: অফিস বা কাজের স্থান।
হিসাব: গণনা বা হিসাব।
৩. তুর্কি ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
তুর্কি ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় অনেকটা ফারসি ভাষার মাধ্যমে এসেছে, তবে কিছু শব্দ সরাসরি তুর্কি উৎস থেকে এসেছে।
তবিলা: ঘোড়ার বাসস্থান।
তোপ: যুদ্ধের কামান।
বেগম: উচ্চবংশীয় মহিলার উপাধি।
লস্কর: সৈন্যবাহিনী।
চক্রী: চাকর বা দাস।
৪. ইংরেজি ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় ব্যাপক শব্দ গ্রহণ করা হয়েছে। অনেক শব্দ বাংলায় প্রায় অপরিবর্তিতভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, আবার কিছু শব্দ বাংলায় রূপান্তরিত হয়েছে।
ট্রেন: রেলগাড়ি।
স্টেশন: রেল বা বাস দাঁড়ানোর স্থান।
অফিস: কাজের স্থান।
কম্পিউটার: গণনা বা তথ্য প্রক্রিয়াকরণের যন্ত্র।
টেলিভিশন: দৃশ্য ও শব্দ সম্প্রচারের যন্ত্র।
ফোন: টেলিযোগাযোগের মাধ্যম।
৫. পর্তুগিজ ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে আসার সময় তাদের সঙ্গে অনেক শব্দও এসেছিল, যা বাংলা ভাষায় মিশে গেছে।
আনানাস: একটি ফল, যা ইংরেজিতে “pineapple”।
চাবি: তালা খোলার যন্ত্র।
তালপাতা: পাতা দিয়ে তৈরি লিখনপত্র।
বালতি: পানি বা অন্যান্য পদার্থ রাখার পাত্র।
আলপিন: ক্ষুদ্র ধাতব পিন।
৬. ডাচ ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
ডাচরা বাংলায় অনেকটা সীমিত প্রভাব ফেলেছিল, তবে তাদের কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছে।
কপাল: জাহাজের সম্মুখভাগ।
লবণ: খাবারের স্বাদ বাড়ানোর উপাদান (ইংরেজির মতোই ব্যবহৃত)।
৭. ফরাসি ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
ফরাসি ভাষা থেকেও কিছু শব্দ বাংলায় এসেছে, যদিও সংখ্যা কম।
অ্যাটাচি: কোনো কূটনীতিক বা প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি।
কুর্তা: একটি পোশাক।
বাশ: কোনো বড় উৎসব বা অনুষ্ঠান (বেশিরভাগ প্রভাব আধুনিক ব্যবহারে)।
৮. হিন্দি ও উর্দু ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দি এবং উর্দু ভাষার প্রভাব অনেকটা স্বাভাবিক ছিল। এই দুই ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনেক শব্দ প্রবেশ করেছে।
রুট: পথ বা রাস্তা।
বিছানা: শোয়ার স্থান।
দুশমন: শত্রু।
জরুর: প্রয়োজনীয় বা অবশ্যই।
পেয়ালা: পানীয় পাত্র।
৯. সংস্কৃত ভাষা থেকে গ্রহণকৃত শব্দ:
সংস্কৃত ভাষা বাংলা ভাষার একটি মূল ভিত্তি, তাই এই ভাষা থেকে অনেক তৎসম শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
বিদ্যালয়: স্কুল।
গুরু: শিক্ষক বা প্রশিক্ষক।
মন্ত্র: বিশেষ ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক শব্দগুচ্ছ।
অগ্নি: আগুন।
দর্শন: দর্শনের জ্ঞান বা চেতনা।
সারসংক্ষেপে, বাংলা ভাষা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করেছে এবং এই শব্দগুলো এখন বাংলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি বিদেশি ভাষা থেকে নেওয়া শব্দগুলি বাংলা ভাষার বিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা ভাষাটিকে আরও সমৃদ্ধ এবং বহুমাত্রিক করেছে।