ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেল কীভাবে বিশ্বে প্রভাব ফেলেছে?

0

ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেল কীভাবে বিশ্বে প্রভাব ফেলেছে?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
0

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ মডেল সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রের একটি বড় বিপ্লব হিসেবে বিবেচিত হয়। তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক মডেলটি ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এই মডেল শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দারিদ্র্য বিমোচনে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। নিচে ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেল কীভাবে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে, তা তুলে ধরা হলো:

১. দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা:
ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেলের মূল লক্ষ্য ছিল দরিদ্র মানুষের আর্থিক স্বাধীনতা প্রদান করা। সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরের মানুষ যারা সামান্য মূলধন না থাকার কারণে কোনো ঋণ সুবিধা পেত না, তাদের জন্য মাইক্রোক্রেডিট ব্যবস্থা চালু করে ড. ইউনূস দেখিয়েছেন যে, ক্ষুদ্রঋণ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে আফ্রিকা, এশিয়া, এবং লাতিন আমেরিকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী এই মডেলের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে। মাইক্রোক্রেডিট দরিদ্র মানুষকে নিজের ব্যবসা শুরু করতে, নিজস্ব পেশায় দক্ষতা বৃদ্ধি করতে এবং নিজেদের পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করতে সহায়ক হয়েছে।
২. নারীর ক্ষমতায়নে ভূমিকা:
ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেলের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি নারী ক্ষমতায়নে বিশাল ভূমিকা পালন করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের অধিকাংশ ঋণগ্রহীতা ছিলেন গ্রামীণ নারী, যাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ড. ইউনূস তাদের ক্ষুদ্রঋণ দিতেন।

বিশ্বব্যাপী এই মডেল গ্রহণের ফলে বহু দরিদ্র নারী নিজস্ব ব্যবসা শুরু করতে পেরেছেন এবং নিজেদের পরিবারে আর্থিক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এর ফলে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩. ঋণ পরিশোধের উচ্চ হার:
ড. ইউনূস দেখিয়েছেন যে, দরিদ্র মানুষেরা ঋণ পরিশোধে অত্যন্ত সৎ এবং দায়িত্বশীল হতে পারে। তার প্রতিষ্ঠিত মডেলে ঋণ পরিশোধের হার অত্যন্ত উচ্চ ছিল, যা বিশ্বের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে মাইক্রোক্রেডিট মডেলের দিকে আকৃষ্ট করেছে।

এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীও তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার মূলধারায় যুক্ত হতে পারে।
৪. বিশ্বব্যাপী মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানের প্রসার:
ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেলের সাফল্যের কারণে বিশ্বজুড়ে বহু মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বর্তমানে প্রায় ১০০ টিরও বেশি দেশে মাইক্রোক্রেডিটের মডেল অনুসরণ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহায়তা করে তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করছে।
৫. জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের সমর্থন:
ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেল জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের মত আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকেও প্রশংসা এবং সমর্থন লাভ করেছে। জাতিসংঘ তার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Millennium Development Goals) অর্জনের জন্য মাইক্রোক্রেডিটকে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করে। এছাড়া, বিশ্বব্যাংক মাইক্রোক্রেডিট মডেলের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দারিদ্র্য বিমোচনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।

৬. নোবেল পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:
ড. ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে। এটি ছিল মাইক্রোক্রেডিট মডেলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির একটি মাইলফলক। এই পুরস্কার বিশ্বজুড়ে মাইক্রোক্রেডিট মডেলের প্রতি মানুষের আস্থা এবং আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তোলে।

৭. কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে প্রভাব:
মাইক্রোক্রেডিট মডেল ক্ষুদ্র কৃষি এবং ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কৃষক এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে মূলধন পেয়ে তাদের কার্যক্রম শুরু করতে বা সম্প্রসারণ করতে পেরেছেন।

বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষুদ্রঋণ প্রাপ্তির মাধ্যমে ক্ষুদ্র কৃষকরা আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি গ্রহণ করতে এবং শিল্প উদ্যোক্তারা নতুন উদ্যোগ শুরু করতে পেরেছেন।
৮. বিকল্প ব্যাংকিং মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা:
ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেল প্রচলিত ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে বিশ্বব্যাপী এক বিশেষ স্বীকৃতি পেয়েছে। যেখানে বড় ব্যাংকগুলো শুধুমাত্র আর্থিকভাবে স্থিতিশীল গ্রাহকদের ঋণ দিয়ে থাকে, সেখানে মাইক্রোক্রেডিট দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষকে আর্থিক সহায়তা দেয়।

বিশ্বের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ড. ইউনূসের মডেলকে অনুসরণ করে মাইক্রোফাইন্যান্স পরিষেবা চালু করেছে এবং এটি দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে একটি সফল মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
৯. সমাজে দারিদ্র্যের একটি নতুন সংজ্ঞা:
ড. ইউনূস দারিদ্র্য সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণার পরিবর্তন এনেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, দরিদ্র মানুষকে ছোট পরিমাণ ঋণ দিয়ে তাদের নিজস্ব উদ্যোগে সম্পৃক্ত করা হলে তারা আর্থিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে পারে এবং দারিদ্র্য দূর করতে পারে। এটি দারিদ্র্যের একটি নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছে, যেখানে ঋণ গ্রহণ এবং কাজে লাগানো মানুষের ক্ষমতায়নের একটি উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

১০. সামাজিক ব্যবসার ধারণা:
মাইক্রোক্রেডিট মডেলের সফলতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ড. ইউনূস সামাজিক ব্যবসা (Social Business) ধারণা প্রবর্তন করেন, যা শুধুমাত্র মুনাফা নয়, বরং সামাজিক সমস্যার সমাধানকে লক্ষ্য করে। তার সামাজিক ব্যবসা ধারণা বিশ্বব্যাপী সামাজিক উদ্যোক্তাদের জন্য একটি নতুন মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেখানে ব্যবসার মূল লক্ষ্য সামাজিক সমস্যার সমাধান।

সারসংক্ষেপ:
ড. ইউনূসের মাইক্রোক্রেডিট মডেল দারিদ্র্য বিমোচন, নারী ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র ব্যবসার প্রসার এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বিপ্লব এনেছে। তার মডেল প্রমাণ করেছে যে, অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে তাদের জীবনের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। তার এই মডেল শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে এবং মাইক্রোফাইন্যান্স ব্যবস্থার একটি সফল উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন 6 দিন পূর্বে
আপনি 1 উত্তরের মধ্যে 1টি দেখছেন, সব উত্তর দেখতে এখানে ক্লিক করুন।

বিভাগসমূহ