জগদীশ চন্দ্র বসুর উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অবদান কী?
জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অসামান্য অবদান রেখেছেন, বিশেষ করে উদ্ভিদের জীবনীশক্তি ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে তাঁর গবেষণা বৈজ্ঞানিক দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটায়। তিনি উদ্ভিদ বিজ্ঞান এবং প্রাণিজীববিজ্ঞানের মধ্যে সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবং প্রমাণ করেছেন যে উদ্ভিদও অনুভব করতে পারে। তার গবেষণা উদ্ভিদবিজ্ঞানকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ এনে দেয়। নিচে তাঁর প্রধান অবদানগুলো তুলে ধরা হলো:
১. উদ্ভিদের অনুভূতি ও প্রতিক্রিয়া:
জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করেন যে উদ্ভিদও প্রাণীদের মতোই পরিবেশগত পরিবর্তন, স্পর্শ, আলো এবং তাপমাত্রার মতো বিভিন্ন উদ্দীপনায় প্রতিক্রিয়া জানায়। তাঁর গবেষণায় দেখা যায়, উদ্ভিদ বাহ্যিক প্রভাবের জন্য ইলেকট্রিক্যাল এবং বায়োকেমিক্যাল সিগন্যালিং-এর মাধ্যমে সাড়া দেয়, যা আগে কল্পনাতীত ছিল। তিনি উদ্ভিদের “অনুভূতি” এবং প্রতিক্রিয়া ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে দেখিয়েছেন যে উদ্ভিদ প্রাণীদের মতোই “জীবনশক্তি” ধারণ করে।
২. ক্রেসকোগ্রাফের উদ্ভাবন:
বসু উদ্ভিদ বিজ্ঞান গবেষণার জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যার নাম ক্রেসকোগ্রাফ। এই যন্ত্রটি উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং তাদের প্রতি বাহ্যিক উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়া নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয়। ক্রেসকোগ্রাফের সাহায্যে তিনি দেখিয়েছেন যে উদ্ভিদের বৃদ্ধি এবং প্রতিক্রিয়া খুব ধীর হলেও তা একটি নির্দিষ্ট ছন্দ মেনে চলে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে উদ্ভিদের অত্যন্ত সূক্ষ্ম পরিবর্তনও মাপা সম্ভব হয়েছে, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করে।
৩. ইলেকট্রিক প্রতিক্রিয়া:
বসু দেখিয়েছিলেন যে উদ্ভিদ প্রাণীজ টিস্যুর মতোই বাহ্যিক উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়ায় ইলেকট্রিক সিগন্যাল উৎপন্ন করে। উদাহরণস্বরূপ, তিনি দেখান যে যদি উদ্ভিদকে কেটে ফেলা হয় বা কোনোরকম আঘাত দেওয়া হয়, তবে প্রাণীদের মতো উদ্ভিদের কোষগুলোও ইলেকট্রিক সিগন্যালের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানায়। এই আবিষ্কারটি উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসে এবং উদ্ভিদের জীবন্ত হওয়ার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৪. উদ্ভিদের ক্লান্তি ও পুনর্জীবন:
জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদের উপর বাহ্যিক চাপ (যেমন: তাপ, আঘাত, বিষাক্ত পদার্থ ইত্যাদি) কীভাবে প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি দেখান যে উদ্ভিদ এই ধরনের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়ে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পরে পুনর্জীবন পায়, ঠিক যেমনটা প্রাণীরাও ক্লান্তি কাটিয়ে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের এই ধারণাটি বিজ্ঞানীদের উদ্ভিদের জীবনীশক্তি সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য করে।
৫. তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব:
জগদীশ চন্দ্র বসু গবেষণা করেন যে তেজস্ক্রিয় পদার্থ উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশের উপর কী প্রভাব ফেলে। তিনি দেখান যে উদ্ভিদও তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা আধুনিক উদ্ভিদবিজ্ঞানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়।
৬. উদ্ভিদের জীবনচক্রে পরিবেশগত প্রভাব:
বসুর গবেষণায় দেখা যায় যে তাপমাত্রা, আলো এবং আর্দ্রতার মতো পরিবেশগত পরিবর্তন উদ্ভিদের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। উদ্ভিদ বাহ্যিক পরিবেশের পরিবর্তন অনুসারে তাদের বৃদ্ধি এবং বিকাশের ধরণ পরিবর্তন করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোন উদ্ভিদকে বেশিক্ষণ সূর্যের তাপে রাখা হয়, তবে তার বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
৭. মাইমোসা উদ্ভিদে প্রতিক্রিয়া:
মাইমোসা বা লজ্জাবতী উদ্ভিদে প্রতিক্রিয়া নিয়ে জগদীশ চন্দ্র বসু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তিনি দেখান যে এই উদ্ভিদ স্পর্শ করলে বা আঘাত করলে দ্রুত পাতা বন্ধ করে ফেলে, যা একটি তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। এই উদাহরণটি ব্যবহার করে তিনি উদ্ভিদের স্নায়বিক সংবেদনশীলতার প্রমাণ দেন।
৮. পূর্ববর্তী ধারণার সংশোধন:
তাঁর সময়ে উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল। উদ্ভিদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বসুর গবেষণাগুলো এই প্রচলিত ধারণাগুলোর সংশোধন এনে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি স্থাপন করে। উদ্ভিদকেও প্রাণীদের মতোই অনুভূতিসম্পন্ন দেখানোর মাধ্যমে তিনি উদ্ভিদ ও প্রাণিজীবের মধ্যে একটি সাদৃশ্য স্থাপন করেন।
৯. আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি:
জগদীশ চন্দ্র বসুর গবেষণাগুলো শুধুমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, বরং আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশংসিত হয়। তাঁর উদ্ভিদবিজ্ঞান সম্পর্কিত গবেষণা বিশ্বের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সংস্থা এবং জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।
১০. বিজ্ঞান ও দর্শনের সংমিশ্রণ:
জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞানের সঙ্গে দর্শনের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে উদ্ভিদের জীবন ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণ রয়েছে এবং এই জীবনশক্তি তাদেরকে প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা দেয়। তার এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।
সারসংক্ষেপ:
জগদীশ চন্দ্র বসু উদ্ভিদ বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটিয়েছেন তাঁর গবেষণার মাধ্যমে। উদ্ভিদের অনুভূতি, প্রতিক্রিয়া, বৃদ্ধি, এবং পরিবেশগত পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তাঁর কাজ উদ্ভিদবিজ্ঞানকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তিনি উদ্ভিদের জৈবিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে এমন সব আবিষ্কার করেন, যা আগে কল্পনাও করা হয়নি। তাঁর গবেষণা আজও উদ্ভিদবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।