‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কী অ্যাডভেঞ্চারিক চিত্র এঁকেছেন?

0

‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কী অ্যাডভেঞ্চারিক চিত্র এঁকেছেন?

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024
0

‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক অনন্য অ্যাডভেঞ্চারিক চিত্র এঁকেছেন, যেখানে তিনি আফ্রিকার বন্য ও রহস্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশের পটভূমিতে এক তরুণের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প বর্ণনা করেছেন। এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অ্যাডভেঞ্চারধর্মী রচনা হিসেবে স্বীকৃত। উপন্যাসটির মূল চরিত্র শঙ্কর এবং তার বিপজ্জনক, রোমাঞ্চকর অভিযানের মধ্য দিয়ে বিভূতিভূষণ এক অত্যন্ত চমকপ্রদ ও জীবন্ত অ্যাডভেঞ্চারিক চিত্র অঙ্কন করেছেন। নিচে এই উপন্যাসে অ্যাডভেঞ্চারের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হলো:

১. শঙ্করের স্বপ্ন ও আফ্রিকায় অভিযানের সূচনা:
শঙ্কর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, একজন তরুণ বাঙালি, যার মনে রয়েছে দুঃসাহসিক অভিযানের স্বপ্ন। তার মনে ঘুরেফিরে বেড়ায় ভ্রমণ এবং অ্যাডভেঞ্চারের আকাঙ্ক্ষা। শঙ্করের আফ্রিকায় পা রাখার মাধ্যমে তার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়, যেখানে সে একেবারে ভিন্ন এক ভূখণ্ড এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়।

শঙ্করের আফ্রিকা যাত্রা কেবল একটি ভৌগোলিক অভিযাত্রাই নয়, বরং তার ব্যক্তিগত মানসিক বিকাশ এবং জীবনের নতুন অভিজ্ঞতা অর্জনেরও প্রতিচ্ছবি। এই যাত্রার শুরু থেকেই পাঠকের মনে দুঃসাহসিক অভিযানের রোমাঞ্চকর উত্তেজনা তৈরি হয়।
২. প্রকৃতির বিপজ্জনক সৌন্দর্য:
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনিতে আফ্রিকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং তার বিপজ্জনক রূপ অত্যন্ত জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে। আফ্রিকার বিশাল বন্যজঙ্গল, বিরাট পর্বতমালা, এবং অজানা ভূখণ্ড শঙ্করের অ্যাডভেঞ্চারের কেন্দ্রে রয়েছে।

তিনি বুনো প্রাণী, যেমন সিংহ, হাতি এবং গণ্ডারের মুখোমুখি হয়, যা তাকে এক বিপজ্জনক যাত্রায় ঠেলে দেয়। লেখক প্রাকৃতিক পরিবেশের এই বিপদগুলোকে এতটাই স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছেন যে পাঠক শঙ্করের সঙ্গে একইভাবে সেই উত্তেজনা এবং বিপদের অনুভূতি অনুভব করতে পারে।
৩. চাঁদের পাহাড় ও রূপকথার মতো গুহা অনুসন্ধান:
উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ হলো চাঁদের পাহাড়, যা এক রহস্যময় পর্বত। শঙ্কর এই পর্বতের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে, যেখানে বলা হয় বিশাল সোনার খনি রয়েছে। তবে চাঁদের পাহাড় শুধুমাত্র সোনা বা সম্পদের উৎস নয়, বরং এটি এক ধরনের বিপদের প্রতীক। এই পর্বত এবং তার আশেপাশের অঞ্চল শঙ্করের জন্য মৃত্যু ও জীবনের এক সীমারেখা হয়ে দাঁড়ায়।

চাঁদের পাহাড়ের গুহা ও তার ভিতরের রত্নের সন্ধান অ্যাডভেঞ্চার এবং রোমাঞ্চের সঙ্গে এক মিথিক্যাল বা রূপকথার রূপ যোগ করে। এই পর্বত এবং গুহা যেন রহস্যে মোড়া এক নতুন পৃথিবী, যেখানে প্রবেশ করা মানেই অজানার মুখোমুখি হওয়া।
৪. ডিয়েগোর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও অভিযানের ঝুঁকি:
শঙ্করের সহযাত্রী ডিয়েগো আলভারেজ একজন অভিজ্ঞ অভিযাত্রী, যিনি শঙ্করের মতোই দুঃসাহসিক অভিযানে বিশ্বাসী। তাদের বন্ধুত্ব এবং একসঙ্গে অভিযানের মাধ্যমে শঙ্কর ধীরে ধীরে বাস্তব অ্যাডভেঞ্চারের মানে উপলব্ধি করতে থাকে।

ডিয়েগোর সঙ্গে শঙ্কর জঙ্গলে বুনো জন্তুদের সঙ্গে লড়াই করে এবং তারা গুহা ও সোনার খনির সন্ধানে বিপজ্জনক পথ অতিক্রম করে। এই অভিযানে ডিয়েগোর মৃত্যুর ঘটনাও অ্যাডভেঞ্চারের বিপদ এবং শঙ্করের সামনে বিপদের বাস্তবতা তুলে ধরে।
৫. অজানা বিপদ এবং বিপজ্জনক প্রাণী:
আফ্রিকার বন্য পরিবেশে শঙ্কর প্রতিনিয়ত অজানা বিপদের সম্মুখীন হয়। সিংহের আক্রমণ, গণ্ডারের সঙ্গে লড়াই এবং বিষধর সাপের মরণফাঁদ তার অভিযাত্রাকে বিপদসংকুল করে তোলে।

শঙ্করের এই বিপদগুলো কেবল তার শারীরিক সাহসের পরিচয় দেয় না, বরং তার মানসিক দৃঢ়তারও প্রমাণ। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিপদের মধ্য দিয়ে শঙ্করের চরিত্রের বিকাশ এবং তার দুঃসাহসিক মনোভাবকে তুলে ধরেছেন।
৬. মানবিক সহানুভূতি ও সংকট মোকাবিলা:
শঙ্করের সাহসিকতার পাশাপাশি তার মানবিকতা ও সহানুভূতি এই উপন্যাসে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। জঙ্গলে বেঁচে থাকার জন্য তাকে বহু সংকট মোকাবিলা করতে হয়, তবু সে কখনও তার মানবিক গুণাবলী হারায় না। ডিয়েগোর মৃত্যুর পর শঙ্কর একা হয়ে পড়লেও সে এক অদম্য সাহসিকতার পরিচয় দেয়।

এই সংকট এবং বিপদের মধ্যে শঙ্করের মানসিক দৃঢ়তা, সংকল্প, এবং ভালো মনের পরিচয় পাওয়া যায়, যা তাকে একজন সত্যিকারের দুঃসাহসিক অভিযাত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
৭. অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের পূরণ:
‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসের মূল বিষয় হলো অজানাকে জানার আকাঙ্ক্ষা এবং নিজের স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য যে কোনো বাধা অতিক্রম করার অদম্য ইচ্ছাশক্তি। শঙ্করের অভিযানের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই কিভাবে একজন মানুষ তার স্বপ্নের পিছনে ছুটে অজানার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং বিপদকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যায়।

৮. ভয় এবং সাহসের দ্বন্দ্ব:
উপন্যাসে শঙ্করকে বারবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে যেখানে তার ভয় এবং সাহসের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। বিশেষ করে অজানা পর্বতমালা এবং বুনো প্রাণীদের মুখোমুখি হয়ে সে ভয় পায়, কিন্তু একই সঙ্গে তার সাহস তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই দ্বন্দ্ব তার চরিত্রকে আরও বাস্তব এবং মানবিক করে তোলে।

৯. প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক:
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাসে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এক গভীর সম্পর্ক ফুটিয়ে তুলেছেন। শঙ্করের আফ্রিকার বন্য প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই শুধু তার শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার পরীক্ষা নয়, বরং প্রকৃতির শক্তির প্রতি তার গভীর সম্মানও প্রকাশ করে।

প্রকৃতির প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধা এবং এর অজানা রহস্যে আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টি উপন্যাসের একটি মূল আকর্ষণ।
সারসংক্ষেপ:
‘চাঁদের পাহাড়’ উপন্যাসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক চমকপ্রদ অ্যাডভেঞ্চারিক চিত্র এঁকেছেন, যেখানে শঙ্করের মতো একজন সাধারণ বাঙালি যুবক আফ্রিকার বন্য প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে পায়। এই উপন্যাসে অজানা ভূখণ্ডের বিপদ, মানবিক সংকল্প, এবং সাহসের এক অনন্য মিশ্রণ ফুটে উঠেছে। শঙ্করের অভিযানের মাধ্যমে বিভূতিভূষণ তার পাঠকদের দুঃসাহসিক অভিযানের জগতে নিয়ে যান, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপেই নতুন চ্যালেঞ্জ এবং রোমাঞ্চ অপেক্ষা করে।

আব্দুল আজিজ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন অক্টোবর 12, 2024

বিভাগসমূহ