সংস্কৃত কী?

মিমাংসিত1.80K বার দেখাভাষাভারতবর্ষ ভাষা
5

সংস্কৃত কী?

নতুন উত্তরের জন্য প্রশ্ন বন্ধ রয়েছে।
আরিফুর রহমান প্রকাশের স্থিতি পরিবর্তিত করেছেন জানুয়ারি 31, 2023
4

সংস্কৃত

সংস্কৃত (সংস্কৃত উচ্চারণ: [ˈsɐ̃skr̩t̪ɐm] संस्कृतम् সংস্কৃতম্‌, সঠিক নাম: संस्कृता वाक्, সংস্কৃতা বাক্, পরবর্তীকালে প্রচলিত অপর নাম: संस्कृतभाषा সংস্কৃতভাষা, “পরিমার্জিত ভাষা”) হল একটি ঐতিহাসিক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের পবিত্র দেবভাষা। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান দুই বিভাগের একটি “শতম” ভুক্ত ভাষা। বর্তমানে সংস্কৃত ভারতের ২২টি সরকারি ভাষার অন্যতম এবং উত্তরাখণ্ড রাজ্যের অন্যতম সরকারি ভাষা।

ধ্রুপদী-সংস্কৃত এই ভাষার প্রামাণ্য ভাষাপ্রকার। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত পাণিনির ব্যাকরণে এই প্রামাণ্যরূপটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপে লাতিন বা প্রাচীন গ্রিক ভাষার যে স্থান, বৃহত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে সংস্কৃত ভাষার সেই স্থান।

ভারতীয় উপমহাদেশ, বিশেষত ভারত ও নেপালের অধিকাংশ আধুনিক ভাষাই এই ভাষার দ্বারা প্রভাবিত।

সংস্কৃতের প্রাক-ধ্রুপদি রূপটি বৈদিক সংস্কৃত নামে পরিচিত। এই ভাষা ঋগ্বেদের ভাষা এবং সংস্কৃতের প্রাচীনতম রূপ। এর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন নিদর্শনটি প্রায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে রচিত। এই কারণে ঋগ্বৈদিক সংস্কৃত হল প্রাচীনতম ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগুলির অন্যতম এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের (ইংরেজি ও অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষা যে পরিবারের সদস্য) আদিতম সদস্য ভাষাগুলির অন্যতম। বৈদিক সংস্কৃতের সঙ্গে প্রাচীন এবং ধ্রুপদী লাতিন,গথিক, প্রাচীন নর্স, প্রাচীন আবেস্তী ও নবতর আবেস্তীর সম্পর্ক অনেকটা দূরের। এর আরও নিকট-আত্মীয় হলো নুরিস্তানি ভাষাগুলো।

সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার কাব্য ও নাটকের ঐতিহ্যশালী ধারাদুটি ছাড়াও বৈজ্ঞানিক, কারিগরি, দার্শনিক ও হিন্দু শাস্ত্রীয় রচনায় সমৃদ্ধ। হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সংস্কৃত হল আনুষ্ঠানিক ভাষা। এই ধর্মে স্তোত্র ও মন্ত্র সবই সংস্কৃতে লিখিত। কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে আজও কথ্য সংস্কৃতের ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে এবং সংস্কৃত ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার নানা প্রচেষ্টাও করা হয়ে থাকে।

ব্যুৎপত্তি

সংস্কৃত ক্রিয়া বিশেষণ সংস্কৃত- কথাটির আক্ষরিক অর্থ “সংযুক্ত করা”, “উন্নত ও সম্পূর্ণ আকারপ্রাপ্ত”, “পরিমার্জিত” বা “সুপ্রসারিত”। শব্দটি সংস্কার ধাতু থেকে উৎসারিত; যার অর্থ “সংযুক্ত করা, রচনা করা, ব্যবস্থাপনা করা ও প্রস্তুত করা”। সং শব্দের অর্থ “সমরূপ” এবং “(স্)কার” শব্দের অর্থ “প্রস্তুত করা”। এই ভাষাটিকে সংস্কৃত বা পরিমার্জিত ভাষা মনে করা হয়। এই কারণে এই ভাষা একটি “পবিত্র” ও “অভিজাত” ভাষা। প্রাচীন ভারতে ধর্মীয় ও শিক্ষাদান-সংক্রান্ত উদ্দেশ্যে লোকপ্রচলিত প্রাকৃত (“প্রাকৃতিক, শিল্পগুণবর্জিত, স্বাভাবিক ও সাধারণ”) ভাষার পরিবর্তে এই ভাষা ব্যবহৃত হত। এই ভাষাকে “দেবভাষা” বলা হত; কারণ প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী এই ভাষা ছিল “দেবগণ ও উপদেবতাগণের ভাষা”।

ইতিহাস

সংস্কৃত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের ইন্দো-ইরানীয় উপপরিবারের সদস্য। এই ভাষার নিকটতম প্রাচীন আত্মীয় হল ইরানীয় আদি পারসিক ও আবেস্তান ভাষাদুটি। বৃহত্তর ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারে সংস্কৃত ভাষার ধ্বনিপরিবর্তন বৈশিষ্ট্যগুলি সাতেম ভাষাসমূহ (বিশেষত স্লাভিক ও বাল্টিক ভাষা) এবং গ্রিক ভাষার অনুরূপ।

সংস্কৃত ও অন্যান্য ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করতে গিয়ে গবেষকগণ একটি অনুপ্রবেশ তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, বর্তমানে যে ভাষাটি সংস্কৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে, তার আদি ভাষাভাষীগণ খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম ভাগে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত পথে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে। এই তত্ত্বের প্রমাণস্বরূপ বাল্টিক ও স্লাভিক ভাষার সঙ্গে ইন্দো-ইরানীয় ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, অ-ইন্দো-ইউরোপীয় ফিনো-আগরিক ভাষাসমূহের সঙ্গে শব্দভাণ্ডার আদানপ্রদান, এবং উদ্ভিদ ও জীবজগতের নামসংক্রান্ত ইন্দো-ইউরোপীয় প্রামাণ্য শব্দগুলিকে তুলে ধরা হয়।

সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীনতম প্রামাণ্য রচনা হল হিন্দু ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মধ্য থেকে শেষ ভাগের মধ্যবর্তী সময়ে এই গ্রন্থ রচিত হয়। এই সময়কার কোনো লিখিত নথি পাওয়া যায় না। যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গ্রন্থের মৌখিক প্রচলনটি বিশ্বাসযোগ্য। কারণ, এই জাতীয় গ্রন্থগুলির সঠিক উচ্চারণকে ধর্মীয় কারণেই গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হত।

ঋগ্বেদ থেকে পাণিনি (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী) পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষার বিকাশ লক্ষিত হয় সামবেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ, ব্রাহ্মণ এসব গ্রন্থগুলিতে। এই সময় থেকে এই ভাষার মর্যাদা, ধর্মীয় ক্ষেত্রে এর ব্যবহার, এবং এর সঠিক উচ্চারণ সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলি এই ভাষার বিবর্তনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী প্রাচীনতম সংস্কৃত ব্যাকরণ, যা আজও বর্তমান রয়েছে। এটি মূলত একটি প্রামাণ্য ব্যাকরণ। এটি বর্ণনামূলক নয়, নির্দেশমূলক প্রামাণ্য গ্রন্থ। যদিও পাণিনির সময় বেদের কয়েকটি অচলিত হয়ে পড়া কয়েকটি বাক্যবন্ধের বর্ণনাও এখানে রয়েছে।

“সংস্কৃত” শব্দটির দ্বারা অন্যান্য ভাষা থেকে পৃথক একটি ভাষাকে বোঝাত না, বরং বোঝাত একটি পরিমার্জিত কথনরীতিকে। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত উচ্চসমাজে স্থান পাওয়া যেত। সাধারণত উচ্চবর্ণের মধ্যেই পাণিনির ব্যাকরণ তথা সংস্কৃত ভাষার চর্চা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ভারতে সংস্কৃত ছিল বিদ্যাচর্চার ভাষা। লোকসাধারণে প্রচলিত প্রাকৃত ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতও সমাজে প্রচলিত ছিল। উল্লেখ্য কথ্য প্রাকৃত ভাষা থেকেই পরবর্তীকালের আধুনিক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগুলির উৎপত্তি হয়।

আরিফুর রহমান সেরা উত্তর হিসাবে নির্বাচন করেছেন জানুয়ারি 12, 2023
0

সংস্কৃত ভারতবর্ষের সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ও সমৃদ্ধ ভাষা। প্রায় পাঁচ হাজার বছর যাবৎ এ ভাষার চর্চা অব্যাহত রয়েছে। ঋগ্বেদে এ ভাষার প্রাচীন রূপটি পরিদৃষ্ট হয়। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দ ঋগ্বেদের রচনাকাল বলে ধরা হয়। ঋগ্বেদ থেকে উপনিষদের কাল পর্যন্ত এ ভাষা বৈদিক ভাষা নামে পরিচিত। প্রাচীনকালে সাধারণ্যে যে ভাষা প্রচলিত ছিল তাকে কেবল ‘ভাষা’ বলা হতো। পরে সংস্কারের মাধ্যমে গৃহীত হওয়ায় এর নাম হয় ‘সংস্কৃত’ (সম্-কৃ+ক্ত)।

কাল ও বিষয়গত দিক থেকে সংস্কৃত ভাষার দুটি স্তর: বৈদিক ও লৌকিক। এই লৌকিক ভাষাই ধ্রুপদী সংস্কৃত ভাষা নামে পরিচিত। এদুটি ভাষার প্রধান পার্থক্য স্বরবৈচিত্র্যে। বৈদিক স্বরধ্বনিতে উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিতভেদে উচ্চারণের তিনটি পর্যায় রয়েছে, কিন্তু সংস্কৃতে এ নিয়ম মানা হয় না। পাণিনিকৃত অষ্টাধ্যায়ী সংস্কৃত ভাষার প্রধান ব্যাকরণগ্রন্থ। পরবর্তীকালে বার্ত্তিককার বররুচি (বা কাত্যায়ন) এবং ভাষ্যকার পতঞ্জলির মাধ্যমে অষ্টাধ্যায়ী পূর্ণতা লাভ করে। তাই এর এক নাম হয় ত্রিমুনিব্যাকরণ। অষ্টাধ্যায়ীতে যেসব অনুশাসন লিপিবদ্ধ হয়েছে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অনুশীলনে সেসবই অনুসরণ করা হয়। অষ্টাধ্যায়ী ব্যতীত সংস্কৃতে আরও অনেক বিখ্যাত ব্যাকরণ রচিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে শর্ববর্মার কাতন্ত্রব্যাকরণ (খ্রি. ১০০), চন্দ্রগোমীর চান্দ্রব্যাকরণ (আনু. ৭ম শতক), ভর্তৃহরির বাক্যপদীয় (৭ম শতক), দুর্গসিংহের কাতন্ত্রসূত্রবৃত্তি (৯ম শতক), হেমচন্দ্রের সিদ্ধহেমচন্দ্রানুশাসন (১০৫০-১১০০), বোপদেবের মুগ্ধবোধব্যাকরণ (১২০০-১২৫০), ক্রমদীশ্বরের জৌমরব্যাকরণ (১২০০-১২৫০), পদ্মনাভ দত্তের সৌপদ্মব্যাকরণ (১৩০০-১৩৫০), রূপ গোস্বামীর (আনু. ১৪৭০-১৫৫৯) হরিনামামৃতব্যাকরণ, ভট্টোজিদীক্ষিতের সিদ্ধান্তকৌমুদী (১৭শ শতক) ইত্যাদি উলে­খযোগ্য।

সংস্কৃত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত ইন্দো-ইরানীয় উপশাখার একটি ভাষা। ভাষাতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক দিক থেকে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহকে দুটি শাখায় ভাগ করা হয়েছে: সতম্ ও কেন্তুম্। সংস্কৃত সতম্ শাখার অন্তর্গত। গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার সঙ্গে এর বিস্ময়কর সাদৃশ্য রয়েছে। এ কারণে এ ভাষাগুলির উৎস এক বলে মনে করা হয়, যা মূল আর্যভাষা বা মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নামে পরিচিত।

সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব কোনো বর্ণমালা নেই। যে অঞ্চলে এর চর্চা হয়েছে সেই অঞ্চলে প্রচলিত বর্ণমালাই এতে গৃহীত হয়েছে। তবে নাগরী বা দেবনাগরী বর্ণমালা সংস্কৃতের জন্য ব্যাপকভাবে গৃহীত, বোধ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।

সংস্কৃত প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা নামেও পরিচিত। আর্যভাষা তিনটি স্তরে বিভাজিত: প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা- বৈদিক ও সংস্কৃত; মধ্যভারতীয় আর্যভাষা- পালি, প্রাকৃত ও অপভ্রংশ এবং নব্যভারতীয় আর্যভাষা- বাংলা, উড়িয়া, হিন্দি, মারাঠি ইত্যাদি। ভাষা অর্থে ‘সংস্কৃত’ শব্দের প্রথম ব্যবহার দেখা যায় রামায়ণে (সুন্দরকান্ড, ৩০/১৭-১৮)।

সংস্কৃত বিভক্ত্যন্ত্য ভাষা। এ ভাষায় কারক-বিভক্তি, প্রত্যয় ও উপসর্গের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাক্যে ব্যবহূত বিভক্তিযুক্ত শব্দকে বলা হয় ‘পদ’; বিভক্তিহীন কোনো শব্দ বাক্যে ব্যবহূত হয় না। তাই বাক্যমধ্যে পদের অবস্থান পরিবর্তনে বাক্যের অর্থপরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা থাকে না; আর এ কারণে বাক্যগঠনে শব্দের অবস্থানের কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই।

সংস্কৃত ভাষায় লিঙ্গ তিনটি- পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গ এবং বচন তিনটি- একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন। ক্রিয়ার কোনো লিঙ্গান্তর হয় না, তবে তার তিনটি বচন ও তিনটি পুরুষ (প্রথম, মধ্যম ও উত্তম) আছে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালসহ কাল ও ভাব বোঝাতে দশ ধরণের ক্রিয়ারূপ ব্যবহূত হয়। সেগুলি সংক্ষেপে দশটি ‘ল-কার’ নামে পরিচিত। ধাতুসমূহ পরস্মৈপদ, আত্মনেপদ ও উভয়পদভেদে তিন ভাগে বিভক্ত। সংস্কৃত একটি অলঙ্কারবহুল ভাষা এবং এর কবিতায় অসংখ্য ছন্দের ব্যবহার দেখা যায়। পাণিনির ব্যাকরণ দ্বারা সুশৃঙ্খল হওয়ায় এ ভাষায় দীর্ঘকাল কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি।

প্রথম দিকে সংস্কৃত ভাষা চর্চার ভৌগোলিক সীমা ছিল ভারতের উত্তরাংশ; কালক্রমে তা পশ্চিম ও পূর্বভারতে বিস্তার লাভ করে। ধীরে ধীরে সংস্কৃতের চর্চা ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী দ্রাবিড়, অস্ট্রিক ও সিনো-টিবেটান জাতির মধ্যেও। ভারতবর্ষের প্রতিবেশী দেশ চীন, তিববত, সুমাত্রা, বোর্নিও এবং পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশগুলিতেও এর প্রভাব বিস্তারিত হয়। প্রাচীন ভারতের ধর্ম-দর্শন ও সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃত ভাষা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। নব্যভারতীয় আর্যভাষাসমূহের গঠনপ্রকৃতি বিশ্লেষণ ও উৎসসন্ধানে সংস্কৃত একান্ত প্রয়োজনীয়।

সংস্কৃত ভাষার অনুশীলন বর্তমানে ভারতেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশেও প্রাচীন যুগ থেকেই এ ভাষার চর্চা হয়ে আসছে এবং বর্তমানেও সীমিতভাবে হচ্ছে। বিভিন্ন বোর্ডের, বিশেষত ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও যশোর বোর্ডের অধীন অনেক স্কুল-কলেজে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের চর্চা হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক সম্মান, স্নাতকোত্তর এবং এমফিল-পিএইচডি পর্যায়ে সংস্কৃতের চর্চা হয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক পাস ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে সংস্কৃত অধ্যয়নের ব্যবস্থা আছে। এছাড়া বাংলাদেশ সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ডের অধীন টোল-চতুষ্পাঠীগুলিতেও সনাতন পদ্ধতিতে সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হয়। এই বোর্ড থেকে সংস্কৃতের বিভিন্ন শাখায় আদ্য, মধ্য ও উপাধি পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে।

সংস্কৃত সাহিত্য কাব্য-নাটকসহ সাহিত্যের সকল শাখা সংস্কৃত ভাষায় অনুশীলিত হয়েছে। ধর্ম, ভাষাবিজ্ঞান, তুলনামূলক ব্যাকরণ, দর্শনশাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র, তর্কবিদ্যা, শারীরবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ফলিতজ্যোতিষ, রসায়ন, বীজগণিত, জ্যামিতি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, পশুবিজ্ঞান, পূর্তবিদ্যা, যৌনবিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়েও সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে অজস্র গ্রন্থ। এসব বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান লাভের জন্য সংস্কৃত ভাষার চর্চা একান্ত আবশ্যক।

সংক্ষেপে চারটি ভাগে সংস্কৃত সাহিত্যের যুগবিভাগ করা যায়: বৈদিক, মহাকাব্য, পুরাণ ও ধ্রুপদী (পাণিনির পরবর্তী) যুগ। বৈদিক সাহিত্যকে সংহিতা (ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব), ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ এ চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়। যাগ-যজ্ঞ কেন্দ্রিক ব্রাহ্মণকে বেদের কর্মকান্ড এবং উপনিষদকে বেদের জ্ঞানকান্ড বলা হয়।

বৈদিক যুগে সূত্রাকারে গ্রথিত এক শ্রেণীর সাহিত্য রচিত হয়, যা সূত্রসাহিত্য নামে পরিচিত। এর চারটি ভাগ: শ্রৌতসূত্র, গৃহ্যসূত্র, ধর্মসূত্র ও শুল্বসূত্র। বহুবিস্তৃত শ্রৌতযাগের বিধি-বিধান শ্রৌতসূত্রে গ্রথিত। গৃহস্থের করণীয় সংস্কার-যাগাদি গৃহ্যসূত্রের বিষয়। ধর্মসম্বন্ধীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ উভয়প্রকার বিধিনিষেধ, চতুর্বর্ণ ও চতুরাশ্রম সম্পর্কিত নিয়মাদি ধর্মসূত্রে লিপিবদ্ধ। শুল্বসূত্রে যজ্ঞবেদী নির্মাণকালে ভূমির পরিমাপের বিষয়াদি লিখিত। সূত্রসাহিত্যসমূহ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে জ্ঞানলাভের ক্ষেত্রে আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত।

সমগ্র বেদকে অধ্যয়নের সহায়ক হিসেবে ছয়টি বেদাঙ্গ রয়েছে; সেগুলি হচ্ছে: শিক্ষা, কল্প, নিরুক্ত, ব্যাকরণ, ছন্দ ও জ্যোতিষ। শিক্ষা মূলত ধ্বনিবিজ্ঞান। বর্ণ, স্বর, মাত্রা ইত্যাদি শিক্ষাগ্রন্থের আলোচ্য বিষয়। প্রত্যেক বেদের পৃথক শিক্ষা আছে। কল্প হচ্ছে সূত্রসাহিত্য। এর দ্বারা যাগযজ্ঞাদি কল্পিত ও সমর্থিত হয় বলে এর নাম হয়েছে কল্প। নিরুক্ত যাস্ক রচিত (আনু. খ্রি.পূ ৬ষ্ঠ শতক)। নিরুক্ত গ্রন্থে বেদের শব্দরাশি সংগৃহীত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে। বেদাঙ্গ হিসেবে ব্যাকরণ অপরিহার্য। অতি প্রাচীন ব্যাকরণরূপে ব্যাসদেবরচিত ব্যাকরণার্ণব এবং মহেশ্বররচিত মাহেশ ব্যাকরণের নাম জানা যায়। ছন্দোবদ্ধ বেদমন্ত্র পাঠের জন্য ছন্দ অবশ্য জ্ঞাতব্য। বেদের মন্ত্র অক্ষরছন্দে রচিত, সংস্কৃতের মতো গণছন্দে নয়। বেদের ছন্দ প্রধানত সাতটি: গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পঙ্ক্তি, জগতী ও ত্রিষ্টুভ। যজ্ঞের সময় নিরূপণে তিথি, নক্ষত্র ইত্যাদি জানার জন্য জ্যোতিষশাস্ত্রের সৃষ্টি। বেদাঙ্গের সঙ্গে বৃহদ্দেবতা ও অনুক্রমণীও স্মর্তব্য। শৌনকের বৃহদ্দেবতায় আছে ঋগ্বেদের সকল দেব-দেবীর কথা, আর অনুক্রমণীতে আছে বেদমন্ত্রের ঋষি, ছন্দ, দেবতা ও বিনিয়োগের কথা।

মহাকাব্যের যুগে প্রথমে রামায়ণ এবং তারপর মহাভারত রচিত হয়। এ দুটি বিশাল মহাকাব্যে প্রতিফলিত হয়েছে ভারতাত্মার বাণী। রামায়ণের রচয়িতা বাল্মীকি। কিংবদন্তি অনুসারে তিনি প্রথম লৌকিক ছন্দের স্রষ্টা এবং আদি কবি। অনুষ্টুপ্ ছন্দে রচিত রামায়ণে বাল্মীকি একজন আদর্শ মানুষের কীর্তিগাথা রচনা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর সেই আদর্শ মানুষ হচ্ছেন রামচন্দ্র। রামায়ণের সাতটি কান্ড।

আকৃতি ও প্রকৃতিতে মহাভারত একখানা বিশাল গ্রন্থ। এর রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। তিনি আঠারো পর্বে কুরুপান্ডবের কাহিনী নিয়ে মহাভারত রচনা করেন। কালান্তরে বিভিন্ন অজ্ঞাত কবির রচনাংশ এতে সংযোজিত হয়েছে। বর্তমানে প্রাপ্ত মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা লক্ষাধিক। মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত হচ্ছে ভগবদ্গীতা। আঠারো অধ্যায়ে রচিত গীতা একটি স্বতন্ত্র এবং শ্রেষ্ঠ গ্রন্থের মর্যাদা পেয়েছে। এ গ্রন্থে জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তিমার্গের কথা আছে।

পুরাণ সাহিত্য বিশাল। তবে প্রধান হিসেবে আঠারোখানা মহাপুরাণ এবং আঠারোখানা উপপুরাণের নাম পাওয়া যায়। পুরাণগুলি বিভিন্ন সময়ে রচিত হয়েছে, কিন্তু পুরাণের রচয়িতা হিসেবে কেবল ব্যাসদেবের নামই পাওয়া যায়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব এই তিন দেবতাকে প্রাধান্য দিয়ে মহাপুরাণগুলির শ্রেণীকরণ করা হয়েছে। পুরাণের বিষয় হিসেবে বিশ্বের সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়, নতুন সৃষ্টি, মনুদের কথা, দেবতাদের কথা, রাজা ও রাজবংশের কথা প্রভৃতি আলোচিত হয়েছে। এছাড়া দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, অলঙ্কারশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস জানার জন্য আকর গ্রন্থ হিসেবে পুরাণের গুরুত্ব অপরিসীম।

ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যকে প্রধানত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে- দৃশ্যকাব্য ও শ্রব্যকাব্য। নাটকাদি দৃশ্যকাব্য, আর পদ্য-গদ্য শ্রব্যকাব্য। এ পর্বের শ্রেষ্ঠ কবি কালিদাস (খ্রি.পূ ১ম শতক)। তাঁর পূর্ববর্তী প্রথিতযশা নাট্যকার ছিলেন ভাস (খ্রি.পূ ৫ম/৪র্থ শতক) ও শূদ্রক (খ্রি.পূ ৩য় শতক) এবং পরবর্তী অশ্বঘোষ (খ্রি. ১ম শতক) প্রমুখ। ভাস তেরোখানা নাটক রচনা করেছেন- যেমন স্বপ্নবাসবদত্ত, চারুদত্ত, উরুভঙ্গ ইত্যাদি। বিষয়বৈচিত্র্য ও আঙ্গিকে ভাসের নাটকগুলি খুবই আকর্ষণীয় এবং সেগুলি রামায়ণ, মহাভারত ও লোকবৃত্তান্ত আশ্রিত। শূদ্রক রচিত মৃচ্ছকটিক সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। কালিদাসের প্রধান রচনাসমূহের মধ্যে রয়েছে কুমারসম্ভব ও রঘুবংশ নামে দুটি মহাকাব্য; দুখানা খন্ডকাব্য ঋতুসংহার ও মেঘদূত; তিনখানা নাটক মালবিকাগ্নিমিত্র, বিক্রমোর্বশীয় এবং অভিজ্ঞানশকুন্তল। অশ্বঘোষ রচিত উলে­খযোগ্য মহাকাব্য বুদ্ধচরিত ও সৌন্দরনন্দ এবং নাট্যগ্রন্থ শারিপুত্রপ্রকরণ। পরের সাহিত্যকীর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিঙ্নাগের নাটক কুন্দমালা (৫ম শতক), ভারবির মহাকাব্য কিরাতার্জুনীয় (৬ষ্ঠ শতক), ভট্টির ভট্টিকাব্য বা রাবণবধ (৬ষ্ঠ শতক), মাঘের শিশুপালবধ (৭ম শতক), শ্রীহর্ষের নাটক রত্নাবলী (৭ম শতক), ভবভূতির উত্তররামচরিত (৭ম/৮ম শতক), ভট্টনারায়ণের বেণীসংহার (৮ম শতক), বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস (৮ম/৯ম শতক), রাজশেখরের বালরামায়ণ (১০ম শতক), জয়দেবের কাব্য গীতগোবিন্দম্ (১২শ শতক), শ্রীহর্ষের নৈষধচরিত (১২শ শতক), কৃষ্ণমিশ্রের রূপক নাটক প্রবোধচন্দ্রোদয় (১১শ শতক), কবিকর্ণপূরের নাটক চৈতন্যচন্দ্রোদয় ও মহাকাব্য চৈতন্যচরিতামৃত (১৬শ শতক) ইত্যাদি। ইতিহাসাশ্রিত কতিপয় বিখ্যাত মহাকাব্য হলো পদ্মগুপ্তের নবসাহসাঙ্কচরিত (১১শ শতক), বিহ্লণের বিক্রমাঙ্কদেবচরিত (১১শ-১২শ শতক), হেমচন্দ্রের কুমারপালচরিত (১০৮৯-১১৭৩), কহ্লণের রাজতঙ্গিণী (১২শ শতক) এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতম্ (১২শ-১৩শ শতক)। বাংলার দুই খ্যাতিমান সাধককবি রূপ গোস্বামী ও জীব গোস্বামীরও অনেক অবদান আছে সংস্কৃত সাহিত্যে।

শত শ্লোকে (কমবেশিও হতে পারে) রচিত শতককাব্য নামে এক শ্রেণীর পদ্যকাব্য আছে। নীতি, শৃঙ্গার, বৈরাগ্য, ভক্তি ও সমাজ এর প্রধান বিষয়। এ শ্রেণীর কাব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অমরুর অমরুশতক (৭ম শতক), ভর্তৃহরির শৃঙ্গারশতক, নীতিশতক ও বৈরাগ্যশতক (৭ম শতক), চন্দ্রমাণিক্যের অপদেশশতক (১৭শ শতক), রুদ্রমাণিক্যের অপদেশীয়শতশ্লোকমালিকা (১৭শ শতক) ইত্যাদি। পঞ্চাশটি শ্লোকে বিহ্লণরচিত চৌরপঞ্চাশিকা শৃঙ্গাররসাশ্রিত একটি জনপ্রিয় কাব্য।

পদ্যকাব্যের মধ্যে কোষকাব্যও অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন কবির কবিতা সংকলিত হয়েছে কোষকাব্যে। এর মধ্যে উলে­খযোগ্য বিদ্যাধরসংকলিত (১১শ শতক) কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়, শ্রীধরদাসকৃত (১৩শ শতক) সদুক্তিকর্ণামৃত, জহ্লণকৃত (১৩শ শতক) সুভাষিতমুক্তাবলী, শার্ঙ্গধরকৃত শার্ঙ্গধরপদ্ধতি (১৪শ শতক), সায়ণাচার্যের সুভাষিতসুধানিধি (১৪শ শতক), বল্লভদেবের সুভাষিতাবলী (১৫শ শতক), রূপ গোস্বামীর পদ্যাবলী (১৬শ শতক), সূর্যকবির (১৬শ শতক) সূক্তিরত্নহার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) শ্লোকমঞ্জরী ইত্যাদি। সংস্কৃত সাহিত্যে শে­ষকাব্য, চিত্রকাব্য, দূতকাব্য, স্তোত্রকাব্য ইত্যাদি নানা শ্রেণীর আরও কাব্য রয়েছে।

শ্রব্যকাব্যের দ্বিতীয় শাখা গদ্যকাব্য। গদ্যের প্রথম নিদর্শন দেখা যায় শুক্লযজুর্বেদে। পরে ব্রাহ্মণ সাহিত্য, কয়েকটি উপনিষদ, ব্যাকরণ ও তার ভাষ্য গদ্যে লেখা হয়েছে। গদ্যকাব্যের মধ্যে বিখ্যাত সুবন্ধুর (৫ম-৭ম শতক) বাসবদত্তা, দন্ডীর (৭ম শতক) দশকুমারচরিত, বাণভট্টের (৭ম শতক) কাদম্বরী ও হর্ষচরিত। সম্রাট হর্ষবর্ধনের জীবনী নিয়ে লেখা হর্ষচরিত বিখ্যাত ঐতিহাসিক গদ্যকাব্য।

গদ্যে লেখা হয়েছে সুবিশাল গল্পসাহিত্য, যার প্রধান উদ্দেশ্য নীতিশিক্ষা দেওয়া। সংস্কৃত সাহিত্যে গল্পকে বলা হয়েছে ‘কথা’। খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকে কথা বা গল্পসাহিত্যের সৃষ্টি ও বিকাশ ঘটেছিল। বিখ্যাত গল্পগ্রন্থ হচ্ছে বিষ্ণুশর্মা রচিত পঞ্চতন্ত্র (১ম/২য় শতক)। একে অবলম্বন করে পরে অনেক গল্পগ্রন্থ রচিত হয়েছে। বঙ্গদেশে রচিত জনপ্রিয় গল্পগ্রন্থ হচ্ছে হিতোপদেশ। ধবলচন্দ্রের (১৪শ শতক) পৃষ্ঠপোষকতায় নারায়ণ এটি রচনা করেন। এছাড়া উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গল্পগ্রন্থ হলো গুণাঢ্যের (১ম শতক) বৃহৎকথা, বুদ্ধস্বামীর (৮ম/৯ম শতক) শে­াকসংগ্রহ, ক্ষেমেন্দ্রের (১১শ শতক) বৃহৎকথামঞ্জরী, সোমদেবের (১১শ শতক) কথাসরিৎসাগর, শিবদাসের বেতালপঞ্চবিংশতি, ক্ষেমঙ্করের সিংহাসনদ্বাত্রিংশিকা (১৩শ শতক) ও চিন্তামণি ভট্টের (১৩শ শতক) শুকসপ্ততিকথা। বৃহৎকথা এখন বিলুপ্ত। কিংবদন্তি অনুসারে সাতলক্ষ শে­াকে পৈশাচী প্রাকৃতে এটি রচিত হয়েছিল। বৃহৎকথামঞ্জরী ও কথাসরিৎসাগর পদ্যে রচিত।

গদ্যপদ্য মিশ্রিত এক শ্রেণীর কাব্য চম্পূ নামে পরিচিত। উলে­খযোগ্য চম্পূকাব্য হলো ত্রিবিক্রম ভট্টের (১০ম শতক) নলচম্পূ ও মদালসাচম্পূ, জৈনাচার্য সোমদেবের (১০ম শতক) যশস্তিলকচম্পূ, ভোজের (১১শ শতক) রামায়ণচম্পূ, অভিনব কালিদাসের (১১শ শতক) ভাগবতচম্পূ, অনন্তভট্টের (১৫শ শতক) ভারতচম্পূ, জীব গোস্বামীর (১৬শ শতক) গোপালচম্পূ, কবিকর্ণপূরের (১৬শ শতক) আনন্দবৃন্দাবনচম্পূ ইত্যাদি।

সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্র খুবই সমৃদ্ধ। এ বিষয়ে প্রাচীনতম গ্রন্থ হলো ভরতের (খ্রি.পূ ২য় – খ্রি. ৩য় শতক) নাট্যশাস্ত্র। উলে­খযোগ্য আরও কয়েকটি গ্রন্থ হলো ভামহের (৬ষ্ঠ-৭ম শতক) কাব্যালঙ্কার, দন্ডীর (৬ষ্ঠ-৭ম শতক) কাব্যাদর্শ, বামনের (৮ম শতক) কাব্যালঙ্কারসূত্রবৃত্তি, উদ্ভটের (৮ম-৯ম শতক) অলঙ্কারসারসংগ্রহ, রুদ্রটের (৮ম শতক) কাব্যালঙ্কার, আনন্দবর্ধনের (৯ম শতক) ধ্বন্যালোক, কুন্তকের (১০ম শতক) বক্রোক্তিজীবিত, ক্ষেমেন্দ্রের (১০ম শতক) ঔচিত্যবিচারচর্চা, ধনঞ্জয়ের (১০ম শতক) দশরূপক, রাজশেখরের (১০ম-১১শ শতক) কাব্যমীমাংসা, অভিনবগুপ্তের (১১শ শতক) ধ্বন্যালোকলোচন ও অভিনবভারতী, মম্মটের (১১শ শতক) কাব্যপ্রকাশ, রুয্যকের অলঙ্কারসর্বস্ব, জগন্নাথের রসগঙ্গাধর, বিশ্বনাথের (১৪শ শতক) সাহিত্যদর্পণ, রূপ গোস্বামীর ভক্তিরসামৃতসিন্ধু ও উজ্জ্বলনীলমণি, কবিকর্ণপূরের অলঙ্কারকৌস্ত্তভ প্রভৃতি।

ছন্দশাস্ত্রের প্রাচীনতম গ্রন্থ পিঙ্গলের ছন্দঃসূত্র (আনু. খ্রি.পূ ৬ষ্ঠ শতক)। এর অনুকরণে রচিত হয় নারায়ণের বৃত্তোক্তিরত্ন এবং চন্দ্রশেখরের বৃত্তমৌক্তিক। এছাড়া উলে­খযোগ্য ছন্দোগ্রন্থ হচ্ছে কালিদাসের শ্রুতবোধ, জয়দেবের (৩য় শতক) জয়দেবছন্দ, কেদারভট্টের (৯ম শতক) বৃত্তরত্নাকর, গঙ্গাদাসের (১০ম শতকের পরবর্তী) ছন্দোমঞ্জরী, ক্ষেমেন্দ্রের (১১শ শতক) সুবৃত্ততিলক, হেমচন্দ্রের (১৫শ শতক) ছন্দোনুশাসন, রামচন্দ্র চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের (১৮শ শতক) বৃত্তরত্নাবলী ইত্যাদি।

ভারতীয় দর্শনের মৌলিক গ্রন্থসমূহ সংস্কৃতে রচিত। তত্ত্ববিদ্যা, শীলবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, পরলোকতত্ত্ব প্রভৃতি দর্শনের আলোচ্য বিষয়। আস্তিক ও নাস্তিক ভেদে দর্শনের দুটি ভাগ। বেদকে প্রামাণ্য হিসেবে স্বীকার-অস্বীকারের ভিত্তিতে এই আস্তিক-নাস্তিক বিভাজন। ছয়টি আস্তিক দর্শন হচ্ছে গৌতমের ন্যায়, কণাদের বৈশেষিক, কপিলের সাংখ্য, পতঞ্জলির যোগ, জৈমিনির মীমাংসা এবং বাদরায়ণের বেদান্ত; বৌদ্ধ, জৈন ও চার্বাক এই তিনটি নাস্তিক দর্শন। বঙ্গদেশে নব্যন্যায় ও রাধাকৃষ্ণভিত্তিক বৈষ্ণবদর্শনের ব্যাপক চর্চা হয়েছে। তন্ত্র একটি স্বতন্ত্র ধারার সাহিত্য। মন্ত্রযন্ত্রাত্মক জ্ঞান, যোগ, ক্রিয়া ও চর্যা এর বিভিন্ন বিভাগ।

ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান, প্রায়শ্চিত্ত, বর্ণাশ্রমধর্ম, রাজধর্ম, আইন-কানুন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্র। ব্যাপকভাবে একে কেবল স্মৃতিও বলে। গৌতম, বৌধায়ন ও বসিষ্ঠের নামাঙ্কিত ধর্মশাস্ত্র উলে­খযোগ্য। সেগুলির কাল আনুমানিক খ্রি.পূ ৬০০-৩০০ অব্দ। স্মৃতিগ্রন্থগুলির মধ্যে মনুসংহিতা ও যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি উলে­খযোগ্য। বাঙালি স্মৃতিকারদের মধ্যে রঘুনন্দনের নাম সর্বাগ্রে উলে­খযোগ্য।

বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ে স্মরণীয় গ্রন্থ বাৎস্যায়নের (আনু. খ্রি. ৩য়-৪র্থ) যৌনবিজ্ঞান সংক্রান্ত কামসূত্র, চিকিৎসাবিজ্ঞানে চরক ও সুশ্রুতসংহিতা (আয়ুর্বেদ নামে পরিচিত), রাষ্ট্রবিজ্ঞানে কৌটিল্য বা চাণক্যের (খ্রি.পূ ৪র্থ শতক) অর্থশাস্ত্র। এ ব্যতিরেকে রসায়ন, উদ্ভিদবিদ্যা, জ্যোতিষ, গণিত, সঙ্গীত, চৌর্যবিদ্যা, রন্ধনশিল্প, কৃষিবিদ্যা, হস্তিবিদ্যা, পশুপালন (বিশেষত অশ্বপালন) প্রভৃতি বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচিত হয়েছে।

বাংলায় সংস্কৃতচর্চা বাংলা অঞ্চলে কখন থেকে সংস্কৃতের চর্চা শুরু হয় তা বলা কঠিন; তবে এর ইতিহাস অনেক প্রাচীন। গুপ্তযুগে আনুমানিক ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে রচিত একটি লেখমালা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক থেকে এখানে সংস্কৃতচর্চার একটি পরিপূর্ণ চিত্র লক্ষ করা যায়। বাঙালি পন্ডিতদের সৃষ্ট রচনারীতি আলঙ্কারিকদের নিকট গৌড়ী বা গৌড়ীয় রীতি নামে পরিচিত ছিল। পাল ও সেনযুগে সংস্কৃতচর্চার বেশ প্রসার ঘটেছিল। মুসলিম শাসনের শুরুতে সংস্কৃত চর্চার ধারা কিছুটা ব্যাহত হলেও পরবর্তী সময়ে ব্যাপক চর্চার নিদর্শন পাওয়া যায়। বিশেষত নবদ্বীপকে কেন্দ্র করে ন্যায়ের চর্চা স্মরণীয়। পনেরো থেকে সতেরো শতক পর্যন্ত নব্যন্যায়ের চর্চায় বঙ্গদেশ ছিল বিখ্যাত। আঠারো ও উনিশ শতকে ব্রিটিশ শাসনামলে সংস্কৃতচর্চায় নবজাগরণ ঘটে। বিশ শতকের শেষদিকে সংস্কৃতচর্চার গতি ক্ষীয়মাণ হলেও অদ্যাবধি সচল রয়েছে।

পাল যুগ (৭৫০-১১৬১) পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধ। তবে তাঁদের সময়ে সংস্কৃত ভাষা-সাহিত্যের উলে­খযোগ্য চর্চা হয়। ভট্টনারায়ণের (খ্রি. ৯ম শতকের পূর্ববর্তী) বেণীসংহার, বিশাখদত্তের (৯ম শতকের পূর্ববর্তী) মুদ্রারাক্ষস, অভিনন্দের (৯ম শতক) রামচরিত, মুরারির (৯ম-১০ম শতক) অনর্ঘরাঘব, নোয়াখালী নিবাসী মৎস্যেন্দ্রনাথের (১০ম শতকের প্রথমভাগ) কৌলজ্ঞাননির্ণয়, বিক্রমপুরনিবাসী অতীশ দীপঙ্করের (৯৮০-১০৫৩) বোধিমার্গপঞ্জিকা, বোধিপথপ্রদীপ, গঙ্গাদাসের (১০ম-১১শ শতক) ছন্দোমঞ্জরী, দিবাকরচন্দ্রের (১০ম-১১শ শতক) হেরুকসাধন, চক্রপাণি দত্তের (১১শ শতক) চিকিৎসাসারসংগ্রহ, নীতিবর্মার (১১শ শতক) কীচকবধ, সন্ধ্যাকার নন্দীর (আনু. ১০৮৪-১১৫৫) রামচরিত, সুরেশ্বরের (১১শ-১২শ শতক) শব্দপ্রদীপ, বৃক্ষায়ুর্বেদ, বিদ্যাকরের (আনু. ১২শ শতক) সুভাষিতরত্নকোষ এ সময়ের উলে­খযোগ্য গ্রন্থ।

সেনযুগ (১০৯৭-১২৬০) সেন রাজারা ছিলেন হিন্দুধর্মাবলম্বী। এ সময়ে হিন্দুধর্মসহ সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপক চর্চা হয়। অনেকের মতে এযুগ ছিল বঙ্গদেশে সংস্কৃত চর্চার স্বর্ণযুগ। বল­ালসেন (১১৫৯-১১৮৫) ও লক্ষ্মণসেন (১১৮৫-১২০৬) উভয়ই ছিলেন বিদ্বান ও সাহিত্যানুরাগী। লক্ষ্মণসেনের সভায় জয়দেব, উমাপতিধর, ধোয়ী, গোবর্ধন ও শরণ নামে পাঁচজন ছিলেন সংস্কৃত কবি। বল­ালসেন দানসাগর, অদ্ভুতসাগর, প্রতিষ্ঠাসাগর, আচারসাগর ও ব্রতসাগর গ্রন্থগুলি রচনা করেন। এছাড়া ভবদেবভট্টের (১১শ-১২শ শতক) ব্যবহারতিলক, কর্মানুষ্ঠানপদ্ধতি, প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ; শ্রীহর্ষের (১২শ শতক) নৈষধচরিত, গোবর্ধনাচার্যের আর্যাসপ্তশতী, ধোয়ীর পবনদূত, জয়দেবের গীতগোবিন্দ, শ্রীধরদাসের (১২শ শতক) সদুক্তিকর্ণামৃত; হলায়ুধ মিশ্রের ব্রাহ্মণসর্বস্ব, মীমাংসাসর্বস্ব, বৈষ্ণবসর্বস্ব, শৈবসর্বস্ব, পন্ডিতসর্বস্ব; পুরুষোত্তমদেবের (১২শ শতক) ভাষাবৃত্তি, হারাবলী; শরণদেবের (১২শ শতক) দুর্ঘটবৃত্তি ইত্যাদি উলে­খযোগ্য গ্রন্থ। কালিকাপুরাণ (১০ম-১১শ শতক), বৃহন্নন্দিকেশ্বরপুরাণ (১১শ-১৪শ শতক) এবং দেবীভাগবতও (১২শ-১৩শ) এ সময়ের রচনা।

মুসলিম যুগ (১২০৬-১৭৫৭) এযুগে সংস্কৃতের উলে­খযোগ্য চর্চা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক চর্চাসহ কাব্য, নাটক, দর্শন ইত্যাদির প্রতিটি শাখায় প্রচুর গ্রন্থ রচিত হয়। প্রধান গ্রন্থসমূহ বৈষ্ণব কবিদের রচনা। বৈষ্ণবদের তীর্থভূমি নবদ্বীপ সংস্কৃতচর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। এ সময়ের উলে­খযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হলো: রূপ গোস্বামীর (আনু. ১৪৭০-১৫৫৯) পদ্যাবলী, হরিনামামৃতব্যাকরণ, উজ্জ্বলনীলমণি; মুরারি গুপ্তের (১৫শ-১৬শ শতক) শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত, সনাতন গোস্বামীর (আনু. ১৪৬৫-১৫৫৫) বৈষ্ণবতোষিণী; রঘুনাথ দাসের (আনু. ১৪৯০-১৫৭৭) দানকেলিচিন্তামণি; বিশ্বনাথ সিদ্ধান্তপঞ্চাননের (১৫শ-১৬শ শতক) কোষকাব্য সূক্তিমুক্তাবলী, রুদ্র ন্যায়বাচস্পতির (১৫শ-১৬শ শতক) ভ্রমরদূত, পিকদূত; জীব গোস্বামীর (আনু. ১৫১৪-১৬০৯) ষট্সন্দর্ভ; কবিকর্ণপূরের (১৫২৫-?) চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যচন্দ্রোদয় (নাটক), গৌরগণোদ্দেশদীপিকা (দর্শন), অলঙ্কারকৌস্ত্তভ; চন্দ্রশেখর (১৬শ-১৭শ শতক) ও গোবিন্দ ভট্টাচার্যের (১৭শ শতক) দুটি ঐতিহাসিক কাব্য শূর্জনচরিত ও পদ্যমুক্তাবলী; ভুলুয়ার (বর্তমান নোয়াখালী) রাজা লক্ষ্মণমাণিক্যের (১৬শ-১৭শ শতক) নাটক বিখ্যাতবিজয়, তাঁর পুত্র অমরমাণিক্যের নাটক বৈকুণ্ঠবিজয়, চন্দ্রমাণিক্যের কাব্য অপদেশশতক, লক্ষ্মণমাণিক্যের সভাকবি রঘুনাথ কবিতার্কিকের প্রহসন কৌতুকরত্নাকর; কৃষ্ণনাথ সার্বভৌম ও তাঁর স্ত্রী বৈজয়ন্তীর (১৭শ শতক) আনন্দলতিকাচম্পূ, প্রিয়ম্বদার (১৭শ শতক) শ্যামারহস্য; বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর (১৭শ শতক) শ্রীকৃষ্ণভাবনামৃত; শ্রীকৃষ্ণ সার্বভৌমের (১৭শ-১৮শ শতক) পদাঙ্কদূত ইত্যাদি।

নব্যস্মৃতি চর্চায় উলে­খযোগ্য জীমূতবাহনের (আনু. ১০৫০-১১৫০) দায়ভাগ; শূলপাণির (আনু. ১৩৭৫-১৪৬০) প্রায়শ্চিত্তবিবেক; কুল­ুভট্টের (১৫শ শতক) স্মৃতিসাগর; শ্রীনাথ আচার্যচূড়ামণির (১৫শ-১৬শ শতক) কৃত্যতত্ত্বার্ণব; রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের (১৫শ-১৬শ শতক) অষ্টাবিংশতিতত্ত্ব, দায়ভাগটীকা ইত্যাদি। এ গ্রন্থগুলি তখন হিন্দুসমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছিল; কোনো কোনোটি বর্তমানেও ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়।

দর্শনে উলে­খযোগ্য বাসুদেব সার্বভৌমের (আনু. ১৪৩০-১৫৪০) অনুমাণপরীক্ষা, রঘুনাথ শিরোমণির (১৫শ-১৬শ শতক) প্রত্যক্ষমণিদীধিতি, অনুমানদীধিতি; রামভদ্র সার্বভৌমের (১৬শ শতক) ন্যায়রহস্য; রঘুনাথ বিদ্যালঙ্কারের (১৬শ শতক) মীমাংসারত্ন, গোপালগঞ্জের (বৃহত্তর ফরিদপুর) কোটালীপাড়ানিবাসী মধুসূদন সরস্বতীর (১৫২৫-১৬৩২) অদ্বৈতসিদ্ধি, বেদান্তকল্পলতিকা, অদ্বৈতমঞ্জরী; বিজ্ঞানভিক্ষুর (১৬শ-১৭ শতক) বিজ্ঞানামৃতভাষ্য ইত্যাদি।

ব্যাকরণে বোপদেবের (১৩শ শতক) মুগ্ধবোধ, ক্রমদীশ্বরের (১৫শ শতক) সংক্ষিপ্তসার, পু্ন্ডরীকাক্ষ বিদ্যাসাগরের (১৫শ-১৬শ শতক) কাতন্ত্রপ্রদীপ প্রভৃতি উলে­খযোগ্য গ্রন্থ। অভিধানে চট্টগ্রাম নিবাসী জটাধরের (১৫শ শতক) অভিধানতন্ত্র, বৃহস্পতি রায়মুকুটের (১৫শ শতক) পদচন্দ্রিকা, ভরত মলি­কের (১৭শ শতক) একবর্ণার্থসংগ্রহ, দ্বিরূপধ্বনিসংগ্রহ; রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতির (১৭শ শতক) ত্রিকান্ডবিবেক ইত্যাদি উলে­খযোগ্য।

অলঙ্কার ও ছন্দে চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যের (১৭শ-১৮শ শতক) কাব্যবিলাস ও বৃত্তরত্নাবলী; তন্ত্রে কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের (১৬শ শতক) তন্ত্রসার, ব্রহ্মানন্দ গিরির (১৬শ শতক) শাক্তানন্দতরঙ্গিণী, নেত্রকোনা জেলার পূর্ণানন্দ পরমহংস পরিব্রাজকের (১৬শ শতক) শ্যামারহস্য, তত্ত্বানন্দতরঙ্গিণী ইত্যাদি উলে­যোগ্য।

ব্রিটিশ যুগ (১৭৫৭-১৯৪৭) এসময় বঙ্গদেশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষে শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির পাশাপাশি সংস্কৃত চর্চায়ও এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। মৌলিক গ্রন্থ রচনা কম হলেও অনুবাদসহ সংস্কৃত পঠন-পাঠনে একটা গতি পরিলক্ষিত হয়।

সংস্কৃত চর্চায় নবদ্বীপের নাম প্রাচীনকাল থেকেই সুপরিচিত। এছাড়া এসময়ে পশ্চিমবঙ্গের ভাটপাড়া বা ভট্টপল­ী, গুপ্তিপাড়া, বর্ধমান, ত্রিবেণী, হাওড়ার বালী, বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর এবং পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর, কোটালীপাড়া, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীতে সংস্কৃতের ব্যাপক চর্চা হয়। সনাতন পদ্ধতিতে সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্রসমূহ টোল নামে পরিচিত। বিভিন্ন সরকারি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বঙ্গদেশে তখন অসংখ্য টোল ছিল এবং প্রত্যেক টোলে ছাত্রসংখ্যাও ছিল প্রচুর।

নব্যন্যায় চর্চার ন্যায় নব্যস্মৃতি চর্চায়ও বাঙালির অবদান অবিস্মরণীয়। এ সময় স্মৃতিগ্রন্থ রচনায় অনেকে উলে­খযোগ্য স্বাক্ষর রাখেন। ত্রিবেণীনিবাসী জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন (১৭৯৪-১৮০৭) স্যার উইলিয়ম জোনসের (১৭৪৬-১৭৯৪) উৎসাহে বিবাদভঙ্গার্ণব নামে একখানা সুবিশাল স্মৃতিগ্রন্থ সঙ্কলন করেন। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে কোলব্রুক (১৭৬৫-১৮৩৭) এ গ্রন্থের অংশবিশেষ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন, যা পরবর্তীকালে Colebroke’s Digest নামে পরিচিত হয়। সমগ্র ভারতবর্ষে হিন্দু আইন সম্পর্কিত বিবাদ মীমাংসায় গ্রন্থটি খুবই সহায়ক হয়েছিল।

বিবাদার্ণবসেতু অপর একটি বিখ্যাত স্মৃতিসংগ্রহগ্রন্থ। এর সংকলয়িতা বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার (আনু. ১৭০০-১৭৮৮) ছিলেন হুগলি জেলার গুপ্তপল­ীর বিখ্যাত শোভাকরের বংশধর। তিনি ওয়ারেন হেস্টিংসের অনুরোধে আরও দশজন বাঙালি পন্ডিতের সহায়তায় বিবাদার্ণবসেতু সংকলন করেন। এ গ্রন্থটিও হিন্দু আইন সম্পর্কিত বিবাদ মীমাংসায় খুবই সহায়ক হয়েছিল। গ্রন্থটি প্রথমে ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়। ফারসি থেকে হ্যালহেড (১৭৫১-১৮৩০) এর ইংরেজি অনুবাদ করেন (A Code of Gentoo Law, London, 1776)।

কাশীচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৮৫৪-১৯১৭) নব্যস্মৃতিশাস্ত্রের একজন বিখ্যাত পন্ডিত। ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তাঁর জন্ম। উদ্ধারচন্দ্রিকা তাঁর মৌলিক গ্রন্থ। তৎকালে সমুদ্র পার হয়ে যাঁরা পাশ্চাত্য দেশে যেতেন, তাঁদের পুনরায় সমাজভুক্ত করার বিষয়টি এতে আলোচিত হয়েছে। কাশীচন্দ্র মনুসংহিতাসহ বিশটি ধর্মশাস্ত্রগ্রন্থের টীকা রচনা করেন।

ময়মনসিংহের শেরপুরনিবাসী মহামহোপাধ্যায় চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার (১৮৩৬-১৯১০) নব্যস্মৃতি বিষয়ে বেশকিছু মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর রচিত উদ্বাহচন্দ্রালোক বাংলার পন্ডিতসমাজে সুপরিচিত। তাঁর আরও দুটি গ্রন্থের নাম শুদ্ধিচন্দ্রালোক ও ঔর্ধ্বদেহিকচন্দ্রালোক। এছাড়া তিনি ব্যাকরণ, কাব্য এবং নাটকও রচনা করেছেন। তাঁর ব্যাকরণগ্রন্থের নাম কাতন্ত্রছন্দঃপ্রক্রিয়া।

উনিশ শতকের শেষপাদ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সংস্কৃত চর্চায় অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ (১৮৭৬-১৯৬১)। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। হরিদাসের রচিত স্মৃতিগ্রন্থ স্মৃতিচিন্তামণি। নব্যস্মৃতির এ গ্রন্থে হিন্দুদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল বিধি-বিধান বঙ্গানুবাদসহ স্থান পেয়েছে।

নব্যন্যায় ও নব্যস্মৃতি চর্চায় আরও কিছু উলে­খযোগ্য নাম হলো কৃষ্ণকান্ত বিদ্যাবাগীশ (১৮শ শতক), গোলোকনাথ ন্যায়রত্ন (১৮০৬-১৮৫৫), হরিনাথ তর্কসিদ্ধান্ত (১৮২৯-১৮৮৯), মহামহোপাধ্যায় কৃষ্ণনাথ ন্যায়পঞ্চানন (১৮৩৩-১৯১১), নবদ্বীপের বিখ্যাত নৈয়ায়িক মহামহোপাধ্যায় কামাখ্যানাথ তর্কবাগীশ (১৮৪৩-১৯৩৬), ভট্টপল­ীর কমলকৃষ্ণ স্মৃতিতীর্থ (১৮৭০-১৯৩৪) প্রমুখ। কৃষ্ণকান্তের ন্যায়রত্নাবলী, তর্কামৃততরঙ্গিণী; কৃষ্ণনাথের ন্যায়প্রকাশ, বেদান্তপরিভাষাটীকা, অর্থসংগ্রহ (মীমাংসা), তত্ত্বকৌমুদী (সাংখ্য); কামাখ্যানাথের সাংখ্যদীপনী, ন্যায়তত্ত্ববোধিনী, ন্যায়কুসুমাঞ্জলির টীকা; কমলকৃষ্ণের সম্পাদিত দানক্রিয়াকৌমুদী, কৃত্যরত্নাকর, রাজধর্মকৌস্ত্তভ প্রভৃতি গ্রন্থ ন্যায় ও স্মৃতি চর্চায় উলে­খযোগ্য অবদান রেখেছে।

ঔপনিবেশিক শাসনামলে দেশীয় অনেক রাজা ও জমিদার সংস্কৃতচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাঁদ ও তিলকচাঁদ, নাটোরের রাজা রামকান্ত ও রানী ভবানী, বিষ্ণুপুরের মল­রাজ গোপাল সিংহ, ঢাকার রাজনগরের রাজবল­ভ সেন প্রমুখ। কৃষ্ণচন্দ্র রায় নদীয়াসহ সমগ্র বাংলার বিভিন্ন স্থানে সংস্কৃতচর্চায় অর্থ দান করেছেন।

এ সময়ের বিভিন্ন সরকারি রিপোর্টে বঙ্গদেশে সংস্কৃত টোল, চতুষ্পাঠী ও কলেজে সংস্কৃতচর্চার বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। সেসব রিপোর্টের মধ্যে উলে­খযোগ্য দুটি হলো উইলিয়ম অ্যাডাম রিপোর্ট (১৮৩৫-১৮৩৮) এবং রেভারেন্ড জেমস লং রিপোর্ট (১৮৬৮)। এগুলি থেকে সমগ্র বাংলায় সংস্কৃতচর্চার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া যায়।

ইউরোপীয়দের সংস্কৃতচর্চা কোম্পানি আমল ও ব্রিটিশ আমলে বিদেশীরা এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শাসনকার্য পরিচালনায় অনুভব করে যে, এ দেশীয় ভাষা ও সাহিত্য জানা একান্ত প্রয়োজন। এই প্রয়োজনবোধ এবং অনেকের প্রাচ্য ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই সংস্কৃত ভাষা চর্চার ক্ষেত্রে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। কতিপয় ইউরোপীয় শাসক, পন্ডিত ও ভাষাবিদের অবদান এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মর্তব্য। তাঁরা হলেন স্যার উইলিয়ম জোনস, স্যার চার্লস উইলকিন্স (১৭৪৯/৫০-১৮৩৬), হেনরি টমাস কোলব্রুক, হোরেস হেম্যান উইলসন (১৭৮৬-১৮৬০) এবং জেমস প্রিন্সেপ (১৭৯৯-১৮৪০)। এঁরা গবেষণা, অনুবাদ, পান্ডুলিপি সংগ্রহ ও সম্পাদনা, প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ইত্যাদি উপায়ে সংস্কৃতের প্রচার ও প্রসার এবং বিশেষভাবে সংস্কৃতকে বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

উইলিয়ম জোনস ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে কলকাতা আসেন। বহুভাষাবিদ জোনসই প্রথম বলেন যে, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার অভিন্ন সম্পর্ক রয়েছে এবং সম্ভবত এসব ভাষা এক আদিম ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রাচ্যের ভাষা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির গবেষণায় তাঁর নেতৃত্বে ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি। এশিয়াটিক রিসার্চেস নামে এ প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পত্রিকার মাধ্যমে তিনি এদেশীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি সম্পর্কে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা থেকে ফ্যাটাল রিং নামে কালিদাসের সংস্কৃত নাটক অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ প্রকাশ করেন। তাঁর এই অনুবাদের মাধ্যমে পাশ্চাত্য প্রথম সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হয়।

কোলব্রুক ভারতে আসেন ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে বেঙ্গল সার্ভিসে রাইটারশিপ নিয়ে। ১৭৮৬ খ্রিস্টাব্দে ত্রিহুতে কালেক্টর হিসেবে নিয়োগলাভের পর তিনি হিন্দু ধর্ম-সংস্কৃতি এবং সংস্কৃত চর্চার প্রতি আগ্রহী হন। জোনসের পরে কোলব্রুক সংস্কৃত চর্চায় উলে­খযোগ্য অবদান রাখেন। তিনি বৈদিক ও পুরাণসাহিত্য এবং সংস্কৃত ব্যাকরণ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। তিনি Grammar of the Sanskrit Language ও Sanskrit Dictionary প্রণয়ন করেন। তাঁর প্রণীত গ্রন্থ The Translation of Two Treaties on the Hindu Law of Inheritance পাঠ করে বিদেশীরা হিন্দু আইন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি এবং ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অধ্যাপক হিসেবে তিনি সংস্কৃতের চর্চা ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

এইচ.এইচ উইলসন ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে একজন ডাক্তার হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে ভারতে আসেন। অল্পকালের মধ্যেই তিনি সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন। ১৮১৩ সালে তিনি কালিদাসের মেঘদূত ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। উইলসনের দুটি বড় কীর্তি হলো Sanskrit English Dictionary প্রণয়ন এবং সংস্কৃত ঐতিহাসিক কাব্য রাজতরঙ্গিণীর আবিষ্কার। শেষোক্ত গ্রন্থ অবলম্বনে তিনি ভারতীয় শাসকবর্গের একটি কালানুক্রমিক ইতিহাসও রচনা করেন। তিনি পুরাণ সাহিত্যের গবেষণার মাধ্যমে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য প্রদানের চেষ্টা করেন। এ সময়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত চর্চার জন্য ‘বোডেন চেয়ার’ নামে একটি অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি করা হয়। উইলসন এই পদে প্রথম অধিষ্ঠিত হয়ে ভারত ত্যাগ করেন। তাঁর আরেকটি অনন্য কীর্তি ঋগ্বেদের ইংরেজি অনুবাদ।

উইলসনের পরে এশিয়াটিক সোসাইটির সম্পাদক হন কলকাতা টাকশালের প্রধান নিরীক্ষক প্রিন্সেপ। তিনি ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব চর্চার ওপর বিশেষ জোর দেন। বিশেষত তাঁরই আগ্রহে অনেক প্রাচীন মুদ্রা ও লিপির ওপর গবেষণার মাধ্যমে বহু রাজা ও রাজবংশের পরিচয় পাওয়া যায়। একটি মুদ্রা থেকে সম্রাট কনিষ্ক এবং এলাহাবাদ স্তম্ভে উৎকীর্ণ লিপি থেকে মৌর্য ও গুপ্তবংশের পরিচয় জানা যায়। প্রিন্সেপের সঙ্গে প্রত্নতত্ত্ববিদ হিসেবে স্মরণীয় জে স্টিভেনসন, ডবি­উ. এইচ মিল, কানিংহাম, উইলসন প্রমুখ।

সংস্কৃত চর্চার প্রসারে উইলকিন্সের নামও নানাভাবে স্মরণীয়। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার হিসেবে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে আসেন। ফারসি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় তিনি দক্ষতা অর্জন করেন এবং এ সকল ভাষার হরফ নির্মাণ ও মুদ্রণশিল্পে বিশেষজ্ঞ হন। হুগলিতে তিনি একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলা ও নাগরী হরফ নির্মাণ করেন। তাই বঙ্গদেশে তিনি মুদ্রণশিল্পের জনক হিসেবে পরিচিত। তিনি সংস্কৃত হিতোপদেশের বঙ্গানুবাদ এবং সংস্কৃতে রচিত বেশ কিছু শিলালিপি ও তাম্রলিপির পাঠোদ্ধার করেন। তাঁর অনূদিত ভগবদ্গীতা ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে মুদ্রিত হয়। এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালএশিয়াটিক রিসার্চেস-এ তাঁর অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেসবের মধ্যে উলে­খযোগ্য কয়েকটি হলো: A Grammar of the Sanskrit Language, Radicals of the Sanskrit Language, Compilation of Jones Manuscripts ইত্যাদি। তিনি মনুসংহিতার কিছু অংশ অনুবাদও করেন।

ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ সংস্কৃত ভাষার চর্চা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠার (১৮০০) মাধ্যমে। এখানে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষাকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হতো। অল্পকাল মধ্যে কোলব্রুক প্রমুখ পন্ডিত ইংরেজি ভাষায় সংস্কৃত ব্যাকরণ প্রণয়ন করেন। প্রকাশিত হয় মুগ্ধবোধ, সিদ্ধান্তকৌমুদী, অমরকোষ এবং উইলসনের সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান। দেশীয় আইন সম্পর্কিত গ্রন্থ মিতাক্ষরা, দায়ভাগ, মনুসংহিতা, দত্তকচন্দ্রিকা, দায়ক্রমসংগ্রহ ইত্যাদিও প্রকাশিত হয়। ব্যাকরণ ও আইনের পাশাপাশি সাহিত্যগ্রন্থ নীতিশতক, শৃঙ্গারশতক, বৈরাগ্যশতক, রামায়ণ, গীতগোবিন্দ, মেঘদূত, শিশুপালবধ, কিরাতার্জুনীয়, হিতোপদেশ, দশকুমারচরিত, নলোদয় প্রভৃতিও প্রকাশিত হয়। ১৮০৫ থেকে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে এ সকল গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বহুল উপকার সাধিত হয়। অনুবাদের মাধ্যমে পাঠকদের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বুঝতেও সহজ হয়।

সংস্কৃত কলেজ ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল হেস্টিংসের নির্দেশে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় সংস্কৃত কলেজ। সংস্কৃত চর্চায় এ কলেজের অবদান অপরিসীম। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) কলেজের অধ্যক্ষ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে কলেজের শিক্ষাদান পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। প্রাচীন ও আধুনিক ধারার সমন্বয়ে সংস্কৃতকে সহজবোধ্য করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। অতীতে সংস্কৃত কলেজে কেবল ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সন্তানদেরই শিক্ষার অধিকার ছিল। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় প্রথমে কায়স্থ সন্তানগণ এবং পরে সকল হিন্দু ভদ্র সন্তানই পড়ার সুযোগ লাভ করেন। তিনি যেমন বাংলা শিশুপাঠ রচনা করেছেন, তেমনি সংস্কৃতে প্রাথমিক জ্ঞান অর্জনের জন্য সহজবোধ্য সংস্কৃত পুস্তকও প্রণয়ন করেছেন। তাঁর রচিত সংস্কৃত ঋজুপাঠ শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। দুর্বোধ্য সংস্কৃত ব্যাকরণকে সহজবোধ্য করার জন্য তিনি রচনা করেন উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী। তিনি রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, সর্বদর্শনসংগ্রহ, উত্তররামচরিত, কাদম্বরী, হর্ষচরিত, অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ প্রভৃতি বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। বিভিন্ন সংস্কৃত গ্রন্থের পরিচ্ছন্ন বঙ্গানুবাদ করে তিনি সংস্কৃত সাহিত্যকে সর্বসাধারণের নিকট আকর্ষণীয় করে তোলেন। বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়ন করেন।

১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হন। তিনি টোল-চতুষ্পাঠীর সংস্কার সাধন এবং সংস্কৃতে উপাধি পরীক্ষার প্রচলন করেন। ১৮৭৯ সালে সংস্কৃত কলেজে প্রথম উপাধি পরীক্ষা হয়। অবশ্য এর এক বছর আগে থেকেই ঢাকার সারস্বত সমাজে এ পরীক্ষা আরম্ভ হয়েছিল। ১৮৮৪ থেকে পূর্বতন ‘বিদ্যাবিনোদ’ ইত্যাদি উপাধি বাদ দিয়ে ‘তীর্থ’ উপাধি (যেমন কাব্যতীর্থ, ব্যাকরণতীর্থ ইত্যাদি) প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

সংস্কৃত কলেজের অনেক অধ্যাপক এবং ছাত্রও সংস্কৃত শিক্ষার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁদের মধ্যে উলে­খযোগ্য জয়গোপাল তর্করত্ন (১৭৭৫-১৮৪৬), ভরতচন্দ্র শিরোমণি, প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ (১৮০৫-১৮৬৭), জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন (১৮০৬-১৮৭২), তারানাথ তর্কবাচস্পতি (১৮১১-১৮৮৫), মদনমোহন তর্কালঙ্কার (১৮১৭-১৮৫৮), প্রমথনাথ তর্কভূষণ (১৮৬৫-১৯৪৪) প্রমুখ।

জয়গোপাল তর্করত্নের জন্ম যশোর জেলার বজরপুরে। তিনি শ্রীবিল্বমঙ্গলকৃত কৃষ্ণবিষয়ক শে­াক রচনা করেন। এতে ১১৯টি শে­াক এবং একই সঙ্গে পয়ার ছন্দে তার বাংলা অনুবাদ আছে। শিক্ষাসার নামক অপর একটি গ্রন্থে তিনি সংযোজন করেছেন গুরুদক্ষিণা, চাণক্যশে­াক এবং শুভঙ্করকৃত আর্যা। এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে দেবনাগরী অক্ষরে প্রকাশিত মহাভারতের তিনি একজন পরিশোধক ছিলেন।

সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক বিখ্যাত স্মার্ত ভরতচন্দ্র শিরোমণি ছিলেন একজন অসাধারণ পন্ডিত। দায়ভাগ, দত্তকমীমাংসা, দত্তকচন্দ্রিকা, স্মৃতিচন্দ্রিকা, চতুর্বর্গচিন্তামণি প্রভৃতি তাঁর উলে­খযোগ্য স্মৃতিগ্রন্থ। তিনি প্রথমে ল’পরীক্ষা কমিটির পন্ডিত এবং পরে বর্ধমানের জজপন্ডিত ছিলেন।

অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের দর্শন ও সাহিত্যে অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তিনি সুন্দর সংস্কৃত শে­াক রচনা করতে পারতেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রঘুবংশের টীকা, নৈষধচরিত, অভিজ্ঞানশকুন্তল, কুমারসম্ভব, কাব্যাদর্শ প্রভৃতি উলে­খযোগ্য।

বিখ্যাত নৈয়ায়িক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চানন ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্নের শিক্ষক। শঙ্করবিজয় ও পদার্থতত্ত্বসার তাঁর প্রণীত দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ। আত্মতত্ত্ববিবেক, কণাদসূত্রবৃত্তি, সর্বদর্শনসংগ্রহ, ন্যায়দর্শন, ভৈরবপঞ্চাশিকা প্রভৃতি তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ।

তারানাথ তর্কবাচস্পতি সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি সিদ্ধান্তকৌমুদী ও বৈয়াকরণভূষণসারসহ বিভিন্ন ব্যাকরণগ্রন্থ; কাদম্বরী, দশকুমারচরিত, হিতোপদেশ প্রভৃতি গদ্যকাব্য; কিরাতার্জুনীয়, শিশুপালবধ, কুমারসম্ভব প্রভৃতি মহাকাব্য এবং মালবিকাগ্নিমিত্র, মহাবীরচরিত, মুদ্রারাক্ষস, রত্নাবলী, বেণীসংহার প্রভৃতি নাটক টীকা ও ব্যাখ্যাসহ সম্পাদনা করেন। শব্দার্থরত্ন, গয়ামাহাত্ম্য, তুলাদানপদ্ধতি প্রভৃতি মৌলিক গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। তাঁর অনন্যসাধারণ কীর্তি শব্দস্তোমমহানিধি এবং বাচস্পত্যাভিধান নামক দুটি অভিধান। কলেজের অধ্যাপনা শেষ করে তিনি নিজগৃহে অবৈতনিক সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠা করে বহু ছাত্রকে বিদ্যা দান করেন।

নদীয়ার বিল্বগ্রামনিবাসী মদনমোহন তর্কালঙ্কার আত্মতত্ত্ববিবেক, কবিকল্পদ্রুম, খন্ডনখন্ডখাদ্য, বাসবদত্তা, কাদম্বরী, দশকুমারচরিত, মেঘদূত প্রভৃতি গ্রন্থ ব্যাখ্যাবিশে­ষণসহ সম্পাদনা করেন। সংস্কৃত কলেজের স্মৃতিশাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন প্রমথনাথ তর্কভূষণ। চবিবশ পরগনা জেলার ভাটপাড়ায় তাঁর জন্ম। তাঁর অনূদিত, ব্যাখ্যাত ও সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে উলে­খযোগ্য বিশুদ্ধানন্দচরিত, কোকিলদূত, রাসরসোদয়, পূর্বমীমাংসার্থ সংগৃহীতটীকা প্রভৃতি।

বিশিষ্ট পন্ডিতবর্গ বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) সংস্কৃত ভাষায় কৃতবিদ্য ছিলেন। উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশ ও সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সঙ্গে সংস্কৃত ভাষায় তাঁর ধর্মবিচার হয় এবং তা পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। গায়ত্র্যাঃ পরমোপাসনাবিধানম্ এবং আত্মানাত্মবিবেক তাঁর রচিত দুটি সংস্কৃত গ্রন্থ। বেদান্ত ও উপনিষদ অবলম্বনে তিনি অনেক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। বেদান্তগ্রন্থ, বেদান্তসার, ঈশোপনিষৎ, তলবকারোপনিষৎ, ভট্টাচার্যের সহিত বিচার, কঠোপনিষৎ, মান্ডূক্যোপনিষৎ, বজ্রসূচী, গীতার পদ্যানুবাদ ইত্যাদি তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থ। তিনি ব্রাহ্মসমাজে বেদজ্ঞ পন্ডিতদের দিয়ে বেদপাঠের ব্যবস্থা করেন।

রাজা রাধাকান্ত দেব (১৭৮৪-১৮৬৭) সংস্কৃতকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে অনেক অর্থ ব্যয় করেন। তাঁর বহু বছরের প্রচেষ্টায় প্রকাশিত হয় সংস্কৃত অভিধান শব্দকল্পদ্রুম। এর মাধ্যমে বিশেষত পাশ্চাত্য পন্ডিতদের পক্ষে এদেশের ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন সহজ হয়।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) সংস্কৃত চর্চার প্রসারে অনেক অধ্যাপক ও ছাত্রকে বৃত্তি প্রদান করেছেন। > ও উপনিষদের প্রচারে তিনি আগ্রহী ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রন্থে উপনিষদের সুন্দর শে­াকসমূহকে সুবিন্যস্ত করেন এবং নিজের সন্তান ও বাড়ির বধূদেরও সংস্কৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করেন।

মহর্ষির প্রথম পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬) অল্প বয়সে মেঘদূতের পদ্যানুবাদ করেন। গীতার ওপর তিনি গীতাপাঠ নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩) গীতা ও মেঘদূতের পদ্যানুবাদ করেন। বৌদ্ধসংস্কৃতেও তাঁর গভীর পান্ডিত্য ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সতেরোটি সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংস্কৃতজ্ঞান সুবিদিত। বেদ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত, মনুসংহিতা এবং কালিদাস, ভবভূতি ও বাণভট্টের রচনাবলি তিনি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। তিনি অন্যদেরও সংস্কৃতপাঠে উৎসাহিত করেছেন। শান্তিনিকেতন এ তিনি বাংলা ভাষার অধ্যাপক ও ছাত্রদের জন্য পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীকে অবশ্যপাঠ্য করেছিলেন। আশ্রম বিদ্যালয়ে সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তিনি নিজে সংস্কৃতপাঠঃ নামে একখানা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। বিশ্বভারতীর মূল আদর্শ তিনি সংস্কৃত ভাষায় প্রস্ত্তত করেন: ‘অথেয়ং বিশ্বভারতী, যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্…।’ সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর তাঁকে ‘কবি সার্বভৌম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন। তিনি অনেক সংস্কৃত স্তোত্র রচনা করেছেন, যার অনেকগুলি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের বন্দনামূলক। সংস্কৃত ভাষায় রচিত তাঁর অনেক চিঠিপত্রও আছে।

ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৯৪) ইংরেজি ভাষায় সুদক্ষ হয়েও সংস্কৃত ভাষার প্রসারে যত্নবান ছিলেন। বিশ্বনাথ ট্রাস্ট ফান্ড ও বিশ্বনাথ চতুষ্পাঠী তাঁর দানে পরিচালিত হয়। তিনি সংস্কৃত ভাষায় জন্মভূমির অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে ‘অধিভারতী’ নামে জননীরূপে বন্দনা করেছেন। তাঁর একটি স্তোত্রের মধ্যে রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’ সঙ্গীতের বীজ। বঙ্কিমচন্দ্রের সংস্কৃত জ্ঞানও সুবিদিত; তাঁর কৃষ্ণচরিত্র, ধর্মতত্ত্ব এবং গীতার অনুবাদে এর পরিচয় পাওয়া যায়।

রমেশচন্দ্র দত্ত (১৮৪৮-১৯০৯) গভীরভাবে সংস্কৃত অনুশীলন করেন। তিনি ঋগ্বেদের বঙ্গানুবাদ এবং হিন্দুশাস্ত্র সম্পাদনা করেন। পদার্থবিজ্ঞানী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী (১৮৬৪-১৯১৯) বৈদিক সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং প্রণয়ন করেন যজ্ঞকথা। এছাড়া তিনি ঐতরেয়ব্রাহ্মণের বঙ্গানুবাদ করেন। কবি নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) চন্ডী ও গীতার পদ্যানুবাদ করেন। সংস্কৃত মহাভারত অনুসরণে তিনি রচনা করেন রৈবতক, কুরুক্ষেত্র ও প্রভাস নামে কাব্যত্রয়।

পুরাতাত্ত্বিক রাজেন্দ্রলাল মিত্রের (১৮২২-১৮৯১) সংস্কৃতে অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তিনি চৈতন্যচন্দ্রোদয়, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, তৈত্তিরীয় আরণ্যক, অগ্নিপুরাণ, গোপথ ব্রাহ্মণসহ বহু সংস্কৃত গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৪০-১৮৭০) সংস্কৃত মহাভারতের মূলানুগ বঙ্গানুবাদ করেন, যা খুবই বিশ্বস্ততা অর্জন করে। তিনি গীতা, বিক্রমোর্বশীয় ও মালতীমাধবও অনুবাদ করেন। তিনি তাঁর বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চে বেণীসংহারের অনুবাদনাটক মঞ্চস্থ করেন।

সংস্কৃত কলেজের প্রথম গ্রন্থাধ্যক্ষ লক্ষ্মীনারায়ণ ন্যায়ালঙ্কার ছিলেন একজন খ্যাতিমান স্মার্ত। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত উলে­খযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে দায়াধিকারিক্রম, দত্তকৌমুদী, মিতাক্ষরা দর্পণ, দায়ভাগ, কবিরহস্যম্, ব্যবহারবিচার শব্দাভিধান।

বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে সংস্কৃতচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এক্ষেত্রে প্রথমেই স্মরণীয় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী র (১৮৫৩-১৯৩১) নাম। তিনি বহু প্রাচীন পুথি আবিষ্কার করে সেগুলি সম্পাদনা করেন। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত উলে­খযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে বৃহদ্ধর্মপুরাণ, চিত্তবিশুদ্ধি প্রকরণ, আনন্দভট্টকৃত বল­ালচরিত, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, আর্যদেবকৃত চতুঃশতিকা, অশ্বঘোষের সৌন্দরনন্দ ইত্যাদি।

অধ্যাপক সুশীলকুমার দে-ও (১৮৯০-১৯৬৮) সংস্কৃত চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল­াহ্ (১৮৮৫-১৯৬৯) এবং ড. মুহম্মদ আবদুল হাই (১৯১৯-১৯৬৯) বাংলার অধ্যাপক হলেও সংস্কৃত চর্চাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেন। পাকিস্তান আমলে সংস্কৃতকে ম্রিয়মাণ অবস্থায় ধরে রাখা এবং পরে স্বাধীন বাংলাদেশে সংস্কৃত চর্চাকে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে উলে­খযোগ্য অবদান রাখেন অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ঘোষঠাকুর। তিনি বিদ্যালয়ের নিম্নশ্রেণী থেকে শুরু করে মহাবিদ্যালয়ের উচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত সংস্কৃত পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর সম্পাদনায় মূল ও বঙ্গানুবাদসহ প্রকাশিত হয় ভাসের নাটক স্বপ্নবাসবদত্ত (১৯৭৪); বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয় সংস্কৃত বর্ণমালার ইতিহাস (১৯৮৫) নামে অপর একখানা মূল্যবান গ্রন্থ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারসহ দেশের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিবিধবিষয়ক অসংখ্য পুথি সংরক্ষিত আছে। বিগত শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে সুশীলকুমার দে, রাধাগোবিন্দ বসাক (১৮৮৫-১৯৮২) ও রমেশচন্দ্র হাজরা কয়েকটি পুথি সম্পাদনা করেন। সেগুলি হলো: কীচকবধ (১৯২৯), পদ্যাবলী (১৯৩৪), কৃষ্ণকর্ণামৃত (১৯৩৮), ঘটকর্পরকাব্য ও কৃত্যতত্ত্বার্ণব। দীর্ঘকাল পরে নববইয়ের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকগণ বেশ কয়েকটি পুথি নিয়ে গবেষণা করেন, যেমন: অপদেশশতক (১৯৯৩), কৌতুকরত্নাকর (১৯৯৮), অপদেশীয়শতশে­াকমালিকা (১৯৯৮), কীর্তিশতক ইত্যাদি। প্রথম দুটি বঙ্গানুবাদসহ গ্রন্থাকারে এবং তৃতীয়টি প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানেও অনেকে পুথি নিয়ে গবেষণা করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের তত্ত্বাবধানে ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ‘পান্ডুলিপি উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প পরিচালিত হয়। এর অধীনে দেশের বিভিন্ন সংগ্রহশালা থেকে প্রচুর সংস্কৃত পুথি এনে সেগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ মাইক্রোফিল্ম সংগ্রহ করা হয়। এছাড়া গ্রন্থাগারের নিজস্ব পুথিসমূহেরও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি লিপিবদ্ধ করা হয় এবং সবগুলি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার তিনটি ইনডেক্স প্রকাশ করে।

গ্রন্থপঞ্জি দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য (ইংরেজ প্রভাবের পূর্ব পর্যন্ত), চতুর্থ সংস্করণ, কলকাতা, ১৯২১; সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সংস্কৃত সাহিত্যে বাঙালীর দান, কলকাতা, ১৯৬২; ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী, ভারতীয় সংস্কৃতির উত্তরাধিকার, কলকাতা, ১৯৮৬; যোগনাথ মুখোপাধ্যায়, ইতিহাস অভিধান (ভারত), কলকাতা, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৯০; সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত, বাংলাদেশের ইতিহাস (১৭০৪-১৯৭১), তৃতীয় খন্ড, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৩।

আরিফুর রহমান প্রকাশের স্থিতি পরিবর্তিত করেছেন জানুয়ারি 10, 2023

বিভাগসমূহ