তিস্তা প্রকল্প বলতে কী বোঝায়?
তিস্তা প্রকল্প (Tista Project) হলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত তিস্তা নদীর পানি সংস্থান, নিয়ন্ত্রণ, এবং ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে গৃহীত বিভিন্ন পরিকল্পনা এবং উদ্যোগের সমন্বয়। তিস্তা নদী উভয় দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ জলস্রোত, যা কৃষি, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তিস্তা নদীর পরিচিতি:
ভৌগোলিক অবস্থা:
উত্স: তিস্তা নদী ভারতের সিকিম রাজ্যের এলাকা থেকে উৎপন্ন হয় এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মিলে গঙ্গা নদীতে মিলিত হয়।
দৈর্ঘ্য: প্রায় ১,০৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের রাজশাহীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।
গুরুত্ব:
তিস্তা নদী কৃষি এবং পানি সরবরাহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি উপকূলীয় অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থা এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়।
নদীটির পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ না করলে বন্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়, যা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার উপর প্রভাব ফেলে।
তিস্তা প্রকল্পের উদ্দেশ্য:
বন্যা নিয়ন্ত্রণ:
তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে বন্যা প্রতিরোধ করা।
বন্যার সময়ে নদীর পানি সংরক্ষণ এবং মুক্তির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো।
সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন:
কৃষিক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থা উন্নত করে কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা।
নদীর পানির ব্যবহারকে দক্ষভাবে পরিচালনা করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন:
তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে জলবিদ্যুৎকে প্রাধান্য দেওয়া।
পানির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা:
নদীর পানির গুণগত মান উন্নয়ন এবং সংরক্ষণ করা।
পানির অপচয় কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা।
প্রকল্পের প্রধান উপাদান:
বন্দরের নির্মাণ:
নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ এবং বন্দর নির্মাণ করা।
বাঁধের মাধ্যমে নদীর পানির স্তর নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেচ ব্যবস্থার জন্য পানি বিতরণ করা।
চ্যানেল ও নল নির্মাণ:
সেচের জন্য চ্যানেল এবং নল স্থাপন করা।
নদীর পানিকে বিভিন্ন কৃষিকাজের স্থানে বিতরণ করা।
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন:
নদীর পানির প্রবাহ ব্যবহার করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কেন্দ্র স্থাপন করা।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে স্থানীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা।
চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যা:
আঞ্চলিক বিরোধ:
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যে পানি ভাগাভাগির বিষয়ে বিভিন্ন মতভেদ রয়েছে।
দুটি দেশের মধ্যে জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সমন্বয় এবং সহযোগিতার অভাব।
প্রকৌশলগত জটিলতা:
তিস্তা নদীর ভৌগোলিক এবং পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বাঁধ ও বন্দর নির্মাণের সময় নদীর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা কঠিন।
অর্থনৈতিক সংস্থান:
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বড় পরিমাণের অর্থনৈতিক সংস্থান প্রয়োজন।
দুই দেশের সরকারকে আর্থিকভাবে সহায়তা এবং বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
বর্তমান অবস্থা:
তিস্তা প্রকল্পের বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে এবং কার্যক্রম চলমান আছে। উভয় দেশেই পানি ব্যবস্থাপনা ও সেচ প্রকল্পগুলিতে নতুন নতুন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তবে পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা এবং সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পের কার্যকর বাস্তবায়ন এখনও সম্পূর্ণ হয়নি।
উপসংহার:
তিস্তা প্রকল্প একটি জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ, যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ, এবং জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে। এই প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন উভয় দেশের জন্যই অত্যন্ত উপকারী হতে পারে, তবে আঞ্চলিক সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, এবং অর্থনৈতিক সংস্থান নিশ্চিত করা অপরিহার্য। তিস্তা প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর পানি সম্পদকে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহৃত করলে এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
তিস্তা প্রকল্প হলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। এ প্রকল্পটি নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে। এর কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালে এবং শেষ হয় ১৯৯০ সালে।
উত্তরাঞ্চল খরাপিড়িত এলাকা হওয়ায় তৎকালিন ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারেজ নিমার্ণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তবে এর মুল পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান আমলে। ১৯৫৭ সালে নির্মাণ কাজ শুরুর পরিকল্পনা থাকলে রাজনৈতিক অস্থিতিলতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৯ সালে ব্যারেজ নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮৫ সালে সৌদি উন্নয়ন তহবিল ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং আবুধাবি উন্নয়ন তহবিলের প্রায় ২,৫০০কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা ব্যারেজসহ সেচ যোগ্য কৃষিজমি ও জলকাঠামো নির্মাণ শুরু হয়। ১৯৯০ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং একই বছর ৫ আগস্ট এর কার্যক্রম চালু হয়। এর মোট নির্মাণ ব্যয়ছিল ১৫শ কোটি টাকা এবং ৫ লক্ষ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে। ২০১৬ সালে ২৬৬ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সংবাদ
তিস্তা নদীতে ভারতের দুটি খাল খনন ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিক্রিয়া