অপভ্রংশ কী?

622 viewsভাষাভাষা
0

অপভ্রংশ (Apabhraṃśa) হল প্রাচীন ভারতীয় ভাষার একটি পর্যায় যা প্রাকৃত ভাষা থেকে উদ্ভূত হয়ে আধুনিক ভারতীয় ভাষার ভিত্তি স্থাপন করেছে। শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় “অপভ্রংশ” বলতে “বিকৃতি” বা “ভ্রষ্ট ভাষা” বোঝায়। এটি প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় ভারতের ভাষাগত পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির বিবর্তনকে চিহ্নিত করে।

অপভ্রংশের উৎস এবং ইতিহাস

প্রাকৃত ভাষা থেকে উদ্ভব:
অপভ্রংশ ভাষাগুলি প্রাকৃত ভাষার বিকৃত বা পরিবর্তিত রূপ হিসেবে বিবেচিত।
প্রাকৃত ভাষা ছিল সংস্কৃতের কথ্য রূপ, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যবহৃত হত।
সময়ের পরিসীমা:
অপভ্রংশ ভাষার ব্যবহার আনুমানিক ৬ষ্ঠ থেকে ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে দেখা যায়।
এই সময়কে “মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা” পর্যায় বলা হয়।
আধুনিক ভাষার ভিত্তি:
অপভ্রংশ ভাষাগুলি থেকে আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষাগুলি, যেমন বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি ইত্যাদি উদ্ভূত হয়েছে।
এই ভাষাগুলির ব্যাকরণ, শব্দভাণ্ডার এবং উচ্চারণে অপভ্রংশের প্রভাব স্পষ্ট।
অপভ্রংশের বৈশিষ্ট্য

ব্যাকরণিক পরিবর্তন:
শব্দের গঠন ও ক্রিয়াপদে পরিবর্তন দেখা যায়।
লিঙ্গ, সংখ্যা এবং ক্রিয়া প্রকরণে সরলতা আসে।
ধ্বনিগত পরিবর্তন:
উচ্চারণে সহজীকরণ ঘটে।
দ্বিস্বরধ্বনি এবং সংক্ষেপণের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়।
শব্দভাণ্ডারের পরিবর্তন:
নতুন শব্দের উদ্ভব এবং পুরাতন শব্দের পরিবর্তন ঘটে।
স্থানীয় উপভাষার প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
অপভ্রংশ সাহিত্য

সাহিত্যিক কর্ম:
অপভ্রংশ ভাষায় অনেক কবিতা, কাহিনী এবং ধর্মীয় গ্রন্থ রচিত হয়েছিল।
জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্যেও অপভ্রংশের ব্যবহার দেখা যায়।
প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক:
সরহপা এবং কানহপা এর মতো বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ অপভ্রংশ ভাষায় রচনা করেছেন।
জৈন কবি স্বয়ম্ভূ এবং পুষ্পদান অপভ্রংশ ভাষায় সাহিত্যকর্ম সম্পাদন করেছেন।
অপভ্রংশের গুরুত্ব

ভাষাগত বিবর্তন বোঝা:
অপভ্রংশ ভাষাগুলি অধ্যয়ন করে আমরা আধুনিক ভারতীয় ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।
সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক মূল্য:
অপভ্রংশ সাহিত্য সেই সময়ের সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চিন্তাধারার প্রতিফলন করে।
ভাষা বিজ্ঞান ও গবেষণা:
ভাষাবিজ্ঞানীরা অপভ্রংশের মাধ্যমে ভাষার পরিবর্তন, ধ্বনিগত পরিবর্তন এবং ব্যাকরণিক সরলতার প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেন।
উপসংহার

অপভ্রংশ হল প্রাচীন ভারতীয় ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যা প্রাকৃত ভাষা থেকে আধুনিক ভারতীয় ভাষার দিকে বিবর্তনের সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছে। ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপভ্রংশের অধ্যয়ন আমাদের ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে গভীর জ্ঞান প্রদান করে। এটি ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অপরিহার্য অধ্যায়।

রুদ্রনীল দাশগুপ্ত Answered question 2 দিন ago